
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে যেসব আসনে যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব মেটাতে কাজ শুরু করেছে দলটি। বিরোধপূর্ণ আসনগুলোর আগ্রহী প্রার্থীদের ডেকে এনে এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে যেকোনো একজন মনোনয়ন পেলে, অন্যজনের জন্য কাজ করতে হবে। বিদ্রোহ বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে নিশ্চিতভাবে সাংগঠনিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
অন্যদিকে বিএনপির দীর্ঘ দিনের জোট সঙ্গী, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলের শীর্ষ নেতাদের জন্য আসন ছাড় দিতে পারে দলটি। অর্থাৎ ওই সব আসনে বিএনপির কোনো প্রার্থী দেওয়া হবে না।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বিরোধ মেটাতে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে আসনসংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের।
অন্য বিভাগগুলোর জন্য আরো কাউকে এই দায়িত্বে যুক্ত করা হতে পারে। গত কয়েক দিনে রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী বা সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে আলাপ করা হয়েছে। গুলশানের বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আগ্রহী ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডাকা হয়। গতকাল বুধবার এ বিষয়ে আলোচনা হয় নেত্রকোনা-৩ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীদের সঙ্গে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর নওগাঁ-৫ আসনের পাঁচজন মনোনয়নপ্রত্যাশীকে ডাকা হয়েছিল গুলশান কার্যালয়ে। তাঁরা হলেন, নওগাঁ জেলা বিএনপির সভাপতি মো. আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু, সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রহমান, নওগাঁ পৌরসভার তিনবারের মেয়র ও বিএনপি নেতা নাজমুল হক সানি, ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়া বিএনপি নেতা জাহিদুল ইসলাম ধলু।
নওগাঁঁ জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি মো. আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, যে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হোক, তাঁর জন্য সবাই মিলে কাজ করতে হবে। যদি মনোনয়ন না পাই, দলের জন্য কাজ করব। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
আল্লাহ নমিনেশন মেলালে ভালো। দেখা যাক, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাহেব সব কিছু যাচাই-বাছাই করেই নমিনেশন দেবেন। সব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে পরিষ্কার লোককেই দেবেন। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় ২০১৪ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখনই আমার মতো সবচেয়ে বেশি ভোটে নওগাঁ জেলায় কেউ নির্বাচিত হতে পারেননি। এর পরও যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হোক না কেন, আমরা সবাই তাঁর জন্য কাজ করব।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সেসব আসনে আগামী নির্বাচনে বেশি প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো থেকে ডাকা হচ্ছে। ওই সব আসনে প্রার্থীর পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আগের নির্বাচনগুলোতে যাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল বা উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনয়ন চান, জনপ্রিয়তা যচাইয়ে না টিকলে তাঁরা বাদ পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে তরুণ ও নতুন প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হতে পারে। তাঁদের ডেকে দলের সিনিয়র নেতারা মতামত নিচ্ছেন একই সঙ্গে পরামর্শও দিচ্ছেন।
উদাহরণ হিসেবে বিএনপির ওই দায়িত্বশীল বলেন, যেমন আগে বাবা এমপি ছিলেন, তাঁর ছেলে প্রত্যাশী। কিন্তু সে তুলনামূলক অন্য প্রার্থীর চেয়ে কম যোগ্য। সে আসনেই পরিবর্তন হবে। আর যদি অন্যদের চেয়ে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হন, তাহলে তিনি বাবার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনয়ন পেতে পারেন।
আলাপ-আলোচনা শেষে একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, কারা মনোনয়ন পাবেন, তাঁর প্রাথমিক তালিকা অক্টোবর মাসের শেষেরদিকে বা নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে ঘোষণা দেওয়া হতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার পরও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর চূড়ান্ত মনোনয়নে কিছু প্রার্থী পরিবর্তন করারও সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে এই সময় বা এক মাসের মধ্যে ডাক পাওয়া আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে থেকে বাছাই করে বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দেওয়া হবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্ততি নিতে। আর বাকি সবাইকে তাঁর সঙ্গে কাজ করতেও নির্দেশ দেওয়া হবে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর জয়পুরহাট-১ আসনের (সদর ও পাঁচবিবি উপজেলা) মনোনয়নপ্রত্যাশী, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফয়সল আলীমকে ডাকা হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে আরো দুজন ছিলেন। ফয়সল আলীমের বাবা মরহুম আব্দুল আলীম সরকার সাবেক মন্ত্রী ও তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। এখন তাঁর সন্তান ফয়সল আলীম জয়পুরহাট-১ আসন থেকে মনোনয়ন চান। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাঁর জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা সবাই যেন থাকি। ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচন করতে হবে।’ গুলশান কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত থেকে এবং বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫০টির বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে আলোচনা ও মতামত গ্রহণ করেছে বিএনপি। যেখানে ২০০ জনেরও বেশি নেতাকে ডাকা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ-৩ (রায়গঞ্জ, সলঙ্গা ও তাড়াশ), সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর ও সদরের একাংশ), রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া ও দুর্গাপুর), বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা), নওগাঁ-৫ (সদর), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া ও কসবা), চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর ও দক্ষিণ), বরিশাল-২ (উজিরপুর ও বানারীপাড়া), বরিশাল-৫, ঝালকাঠি-২ (সদর ও নলছিটি)।
শরীকদের ছাড় দেওয়া হতে পারে অন্তত ৪০-৫০ আসন : আগামী নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে থাকছে না বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করা দল ও ১২ দলীয় জোটের নেতাদের আসন ছাড় দেওয়া হবে। এসব দলের নেতাদের এলাকায় গিয়ে জনসম্পৃক্ত হতে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর ছয় নেতাকে এলাকায় জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে স্থানীয় নেতাদের চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। ছয় নেতারা হলেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব (লক্ষ্মীপুর-৪), নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না (বগুড়া-৪), গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি (ঢাকা-১২ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬), গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর (পটুয়াখালী-৩), সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান (ঝিনাইদহ-২) এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা (কিশোরগঞ্জ-৫)।
জানা গেছে, আনুষ্ঠানিক এই চিঠির বাইরে সম্প্রতি বিএনপির পক্ষ থেকে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিমকে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে নির্বাচনী কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া মোস্তফা জামাল হায়দারকে পিরোজপুর-১ আসন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থকে ঢাকা-১৭ আসন), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে ঢাকা-১৩ আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। আর ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে বিএনপির কাছে ২০ জনের জন্য ২০টি আসনের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। ওই সব আসনে তারা ছাড় চান।
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে অক্টোবরে অন্তত ২০০ আসনের প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে শুনেছি। আমাদের ধারণা যুগপৎ আন্দোলন ও সমমনা জোটের জন্য ৪০-৫০টি আসন ছাড় দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে আমাদের বেশ কয়েকজনকে সবুজসংকেত বা ইতিবাচক বার্তা দেওয়া হয়েছে। সবাইকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। আরো ১৫-২০ দিন আগে এটা করলে ভালো হতো। কারণ যাকে যে আসনই দেওয়া হোক না কেন, মাঠে গিয়ে যেন তিনি কাজ শুরু করতে পারেন। এতে মাঠ গুছিয়ে নেওয়া সুবিধা হবে। কারণ প্রতিপক্ষরা (জামায়াতে ইসলামী) তিন-চার মাস আগে প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে কাজ করছে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ