প্রচ্ছদ সারাদেশ স্বাধীনতা পেয়ে গেছি, হাত হারানোর কষ্ট ভুলে যাব

স্বাধীনতা পেয়ে গেছি, হাত হারানোর কষ্ট ভুলে যাব

সারাদেশ: হাসপাতালের শয্যায় হাসিমুখে বসে আছেন এক তরুণ। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট। চোখে আত্মবিশ্বাস ও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়। তবে মুখটা হাস্যোজ্জ্বল হলেও তাঁর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। কারণ তাঁর এক হাত নেই; সেখানে ব্যান্ডেজ করা। ওই তরুণের এমন একটি ছবি গত ১৮ আগস্ট নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন জিয়াদ হোসাইন মিকু নামে একজন। ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘আজ আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সাহসী ছেলেদের মধ্যে একজনকে দেখলাম। ছবির ছেলেটি আতিকুল। ৫ আগস্ট বিকেলে উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয় সে। এর ফলে ডান হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। কিন্তু তার জীবনে প্রেরণার কোনো অভাব ছিল না। সারাক্ষণ সে হাসছিল এবং আমাদের বলেছিল– আঙ্কেল লাগলে আবার যামু। দরকার হইলে আরেকটা হাত হারামু।’জিয়াদ হোসেনের এই পোস্ট গতকাল বুধবার পর্যন্ত ১৩ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী শেয়ার করেছেন। সবাই ক্যাপশনে আতিকুল ইসলামের সাহসের প্রশংসা করে তাঁকে ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ আখ্যা দিয়েছেন। ওই ছবি তোলার সময় তিনি রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি ছিলেন। কয়েকদিন পর তাঁর খোঁজে কয়েকবার সেখানে গিয়েও পাওয়া যায়নি। জানা যায়, তিনি তিনবার চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। কিছুদিন পর আবার আসবেন। অবশেষে গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁর দেখা মেলে হাসপাতালের মডেল ‘বি’ ওয়ার্ডের ৩৯ নম্বর শয্যায়। তখনও হাস্যোজ্জ্বল আতিকুল। পাশে বসে আছেন তাঁর মা আমেনা বেগম।

আতিকুল জানান, তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা আতাউল ইসলাম বয়সের ভারে ন্যুব্জ; তেমন কাজ করতে পারেন না। তাদের পুরোনো আসবাবের একটি দোকান আছে। মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। উত্তরার আজমপুরে একটি ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে সবাই গাদাগাদি করে থাকেন। পাঁচ ভাই-বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আতিকুল নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। জীবিকার তাগিদে পড়াশোনা ছেড়ে তিন বছর ধরে উত্তরার একটি ফ্যাশন হাউসে বিক্রয়কর্মী হিসেবে চাকরি করেন। শুরু থেকেই তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। হাত হারানোর ঘটনার বর্ণনায় আতিকুল বলেন, ‘আমি প্রতিদিন আজমপুর এলাকায় আন্দোলনে যেতাম। ৫ আগস্ট সকাল থেকে উত্তরার অবস্থা ভয়াবহ রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বাহিনী টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও গুলি ছোড়ে। বিকেলে একটি গুলি আমার ডান হাতে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ি। ছাত্ররা উদ্ধার করে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থা জটিল দেখে নেওয়া হয় হৃদরোগ হাসপাতালে। সেখানে অপারেশন করে গুলি বের করেন ডাক্তার। ৭ আগস্ট সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে হাত কেটে ফেলা হয়। এ পর্যন্ত তিনবার অপারেশন করা লেগেছে।’

হাত হারালেও কোনো আক্ষেপ নেই এই তরুণের। হারাননি মনোবল। আতিকুল বলেন, ‘প্রতিজ্ঞা করে আন্দোলনে নেমেছিলাম– হয় মরব, না হয় বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরব। যেটার জন্য লড়াই করেছি, সেটা পেয়েছি। তাই হাত হারিয়ে কোনো কষ্ট নেই, হতাশা নেই। বিজয় আনতে পেরেছি এটাই বড় কথা। তবে যে ক্ষতি হয়েছে, এটা কল্পনায় ছিল না। এভাবে বাঁচতে হবে ভাবিনি। আমার এক অঙ্গদানের বিনিয়মে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। নতুন বাংলাদেশ শান্তি, সমৃদ্ধি ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হোক।’তিনি আরও বলেন, ‘আর হয়তো চাকরি ফিরে পাব না। স্বপ্ন ছিল, টাকা গুছিয়ে বিদেশে গিয়ে ভালো চাকরি করব। কিন্তু এখন সেই চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। এখন প্রথম কাজ সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা। নতুন সরকারের কাছে সাধারণ একটি আবদার বা অনুরোধ করতে চাই। আমাদের যোগ্যতা অনুসারে একটা চাকরি দেওয়া হোক, যাতে ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারি। সংসারের হাল ধরতে পারি।’ আতিকুল জানান, চিকিৎসকরা তাঁর কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন। একটি বেসরকারি সংস্থাও কৃত্রিম হাত লাগানোর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দু-এক মাসের মধ্যে হয়তো কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা হবে। আমেনা বেগম জানান, ছেলের চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। সবই ঋণ করা। সরকার আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার ব্যয় বহনের ঘোষণা দিলেও আতিকুলের চিকিৎসা ব্যয়ের কোনো বিল বা নথি না থাকায় সহায়তার আশা ছেড়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার সহযোগিতা করলে ছেলের হাত হারানোর কষ্ট হয়তো কিছুটা ভুলে থাকতে পারব। স্বপ্ন ছিল আতিকুলকে বিদেশে পাঠাব। তার আয়ে গ্রামে বাড়ি করে ময়মনসিংহ ফিরব। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।’ আতিকুলের মতো এখনও প্রায় ১০০ জন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত এসব ব্যক্তিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো, নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পরিবারকে এককালীন ১ কোটি টাকা দেওয়াসহ পাঁচটি অনুরোধ করেছেন তারা। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তাদের পক্ষে এমন অনুরোধ জানান সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সালমান হোসেন।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।