
ইতিহাস গড়েছে ছাত্রশিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ২৮টি পদের বিপরীতে ২৩টিতে জয় পেয়েছে। শুধু তাই নয় ভিপি, জিএস, এজিএস প্রার্থী পেয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ভোট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া প্রার্থী অর্ধেকেরও কম ভোট পেয়েছেন। ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে ভিপি (সহ-সভাপতি) নির্বাচিত হয়েছেন আবু সাদিক কায়েম। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত ‘আবিদ হামিম-মায়েদ পরিষদ’ থেকে আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। শিবিরের জিএস (সাধারণ সম্পাদক) ও এজিএস পদে বড় জয় পেয়েছেন এস এম ফরহাদ ও মুহা. মহিউদ্দীন খান। তারা পেয়েছেন যথাক্রমে ১০ হাজার ৭৯৪ ও ১১ হাজার ৭৭২ ভোট।
গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় এই ভোট। প্রচারণার সময়, ভোটের দিন ও পরবর্তী সময়ে একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে উত্তর মেলে শিবিরের ভূমিধস জয়ের। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত ১৭ বছরের ক্রমাগত নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা, শিবির পরিচয়ের কারণে নিপীড়নের অভিজ্ঞতা তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করেছে। রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে নির্যাতনের সংস্কৃতি ঢাবিতে দীর্ঘদিন ধরে চলায় শিবিরের প্রতি সহমর্মিতা তৈরি হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। ইসলামিক আচার অনুষ্ঠান, বিশেষত ছাত্রলীগের আমলে কোরআন তেলাওয়াতের অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনাও শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক সহানুভূতির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রদলের হল কমিটিতে ছাত্রলীগের ছড়াছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংগঠনটিকে ছাত্রলীগের মতো একই পাল্লায় মেপেছেন শিক্ষার্থীরা। ফলে বিরাট ভোট পেতে সক্ষম হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সবথেকে বেশি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে শিবিরের রাজনীতি করা প্রার্থীদের আর্থিক দুর্নীতি না থাকা ও আচরণে নমনীয়তা থাকার বিষয়টি।
অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলোর ক্যাম্পেইনের কৌশলগত দুর্বলতা শিবিরকে এগিয়ে রেখেছে। ছাত্রদল নানা কারণে সমম্যায় ছিল। তাদের প্রার্থীদের নিয়েও সংগঠনেই বিরোধ ছিল। বামজোট কার্যকর কোনো প্রচার চালাতে পারেনি। ছাত্রদলের প্রার্থীদের সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারে। বেসরকারি একটি টেলিভিশন টকশোতে ছাত্রদলের এজিএস পদপ্রার্থী এক প্রার্থীকে শিবিরকর্মী বলে ট্যাগ দেয়ায় তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের বয়স বেশি এমন একটি অংশকে তারা এবার প্রার্থীই করেনি। এর ফলে তারা ভোটের ক্যাম্পেইনে নিষ্ক্রিয় ছিল।
এ ছাড়াও বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয় ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে। জিএস প্রার্থী তানভীর বারী হামিম মিছিল নিয়ে স্লোগান দিয়ে আচরণবিধি ভঙ্গ করেন এমন অভিযোগ করা হয়। প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে এভাবে বারবার অভিযোগ তোলায় এগুলো শিক্ষার্থীদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিপরীত দিকে সংগঠিত ও পরিকল্পিত ছিল শিবিরের প্রার্থীদের পদচারণা। এ ছাড়াও ’২৪ আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা ছাত্রনেতাদের বিভক্তিও শিবিরের জন্য এক ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
সুসংগঠিতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রশিবিরের দলীয় কর্মসূচি ও শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মকাণ্ড পৌঁছে দেয়া বড় ভূমিকা রেখেছে শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ে। গত এক বছর ধরে হলে থাকা শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যা নিয়ে পরিকল্পিত কাজ করেছে শিবির। হলের খাবারের মান বাড়ানোসহ কিছু উদ্যোগও ছিল তাদের। এ কারণে হলের শিক্ষার্থীরা শিবিরের প্রতি বেশি সমর্থন দেন।
ওদিকে নারী শিক্ষার্থীদের নিজেদের পক্ষে আনার কৌশল শিবিরের ভূমিধস জয়ে বড় ভূমিকা রাখে। নারী ভোটারদের বড় অংশ শিবিরপন্থি প্যানেলকে সমর্থন করেছেন। একাধিক নারী শিক্ষার্থী বলেন, শিবিরের রাজনীতি পছন্দ না করলেও প্যানেলের প্রার্থীদের তারা বিশ্বাস করেন। বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল ও শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরা শিবিরকে ভিন্ন রকম চোখে দেখছেন। বিশেষত ছাত্রীদের মতামত হলো, মাদারপার্টির আজ্ঞাবহ দলকে তারা মোটেই গ্রাহ্য করবেন না। ছাত্রীরা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছেন ২০০২ সালের শামসুন্নাহার হলে সংঘটিত হামলার ঘটনায়। বিরোধী প্রার্থীরা ওই ঘটনার বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। গত ২৬শে আগস্ট প্রচারণার শুরুর দিন শিবির সমর্থিত প্যানেলের একটি ব্যানার ভেঙে ফেলে একদল ছাত্র। ঘটনাটি ঘটে ঢাবি’র চারুকলা অনুষদ এলাকায়। কিছুক্ষণ পর আরেকটি ব্যানারে ছাত্রী সংস্থার সভাপতি সাবিকুন্নাহার তামান্নার হিজাব পরা ছবি বিকৃত করে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফেলে রাখা হয়। মুহূর্তেই তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় ওঠে। এ ছাড়াও প্রচারণার সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় ৬৯৪ বার হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক মন্তব্যের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন ফাতেমা তাসনিম জুমা। এত বাধা ও প্রতিকূলতার বিষয়টি সামনে আসলে নারী ভোটাররা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হন বলে কেউ কেউ মনে করেন।
শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশ মনে করেন ভিপি পদে বিজয়ী সাদিক কায়েমের গ্রহণযোগ্যতা বড় ভূমিকা রেখেছে। জুলাই আন্দোলনের পর থেকে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে একজন ভদ্র, নির্লিপ্ত ও বিতর্কমুক্ত চরিত্র হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে তীক্ষ্ণ এবং ব্যক্তিগত সততা থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা তাকে ‘রাজনৈতিক নেতা’ নয় বরং ‘নিজেদের মতো একজন ছাত্র-নেতা’ হিসেবে দেখেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাদিকের হাসিখুশি ছবি ও আন্তরিক ভঙ্গি ভোটারদের দৃষ্টি কেড়েছে।
শিবির তার সাংগঠনিক পূর্ণ শক্তি কাজে লাগিয়েছে ডাকসুতে। শিবির দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির মাধ্যমে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। যেখানে ছাত্রদল টানা দুই প্রজন্ম ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিল। ফলে তারা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি।
এর বাইরে ছাত্রশিবির মেডিকেল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন কোচিং পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘ দিন থেকে। এর সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভর্তির আগে থেকেই হয়ে থাকে। এটিও শিবিরের সুবিধা পাওয়ার বড় একটি কারণ।
সূত্র: মানবজমিন











































