প্রচ্ছদ জাতীয় ‘বুকভরা হতাশা’ নিয়ে এনসিপি নেতার পদত্যাগ

‘বুকভরা হতাশা’ নিয়ে এনসিপি নেতার পদত্যাগ

জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন আরিফুল ইসলাম তালুকদার। ২৮ নভেম্বর তিনি দলের আহ্বায়ক বরাবর আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন।

চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার অভিযোগ, দল অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতার অপব্যবহার, সিদ্ধান্তহীনতা ও অনিয়মের কারণে তিনি পদত্যাগ করছেন পাননি।

সদস্য সচিব বরাবর তিনি লিখেছেন, ‘আমি আপনার দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক কমিটির সংগঠকের দায়িত্ব পাই। যদিও পদ-পদবি নিয়ে আমার কোনো পছন্দই ছিল না। কারণ আমি চেয়েছিলাম ২০১৮ এবং ২০২৪—দুটো আন্দোলনের দেশপ্রেমিক তারুণ্যের শক্তি একত্রিত হয়ে বাংলাদেশে তারুণ্যের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বিনির্মাণ করুক। একতাবদ্ধ তারুণ্যের শক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিক। সেজন্য নিজের জায়গা থেকে যথাসাধ্য কাজ করেছি। তারুণ্যের দুটো আলোচিত শক্তি একতাবদ্ধ হওয়ার একদম দ্বারপ্রান্তে এসেও কিছু হীনমন্যতা ও অদূরদর্শী আচরণের কাছে পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

অন্যদিকে একই প্রেক্ষাপটে উঠে আসা আমাদের দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ বিস্ময়কর রকম অর্থসম্পদের মালিক হয়েছে, যা সাধারণ জনগণসহ জুলাইয়ের সকল শরিকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে এবং শরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে জুলাইয়ের সম্পূর্ণ অবদান নিজেদের কাছে কুক্ষিগত করেছে। যার ফলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে এবং আমাদের বিপ্লবকে অনেকটাই বিবর্ণ করেছে। যা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে।

জুলাইয়ের আহতদের প্রকৃত তালিকাকরণে সীমাহীন অবিচার করা হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট রাষ্ট্রের প্রায় অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র একটি নির্দিষ্ট বলয় দখল করেছে। সচিবালয়সহ পুরো রাষ্ট্রের ৯০ ভাগেরও বেশি ফ্যাসিবাদী আমলা বহাল রয়েছে। গণহত্যার বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি, এমনকি গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলের বিষয়ে যথাযথ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

আমি বিস্ময়ের সঙ্গে আরও লক্ষ্য করেছি, যে আমলারা গত ৩টি নির্বাচন মাফিয়ার হয়ে করে দিয়েছে—সেই আমলাদের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি সম্পন্ন। আর এসবের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। এমনকি মাফিয়া রেখে যাওয়া রাষ্ট্রপতির অধীনেই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। একের পর এক ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, নিজস্ব বলয়-সৃষ্টি ও দুর্নীতির বিষয়গুলো সামনে আসছে যার দায়ভার আমাকেও নিতে হচ্ছে।

এই কথাগুলো আপনাকে বলছি কারণ, বিপ্লবোত্তর দেশের এই সংকটের দায় পুরোপুরি আপনাদের। অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে যারা বছরের পর বছর জীবন ও ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে কাজ করেছে—তাদের স্বীকৃতি কেড়ে নেওয়ার দায়সহ দেশের উদ্ভূত সংকটগুলোর দায় কেবল তাদের যারা অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে নিজেদের বলয়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করেছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের দায়িত্ব আপনাদের হাতেই দিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে আপনারা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন, কেননা আপনাদের পছন্দসই উপদেষ্টা পরিষদ বিগত দেড় বছরে ব্যর্থতা ও অনৈক্য ছাড়া বাংলাদেশকে তেমন কিছুই উপহার দিতে পারেনি। আর এই দায় সরাসরি আপনাদের উপরই বর্তায়।

আমি জুলাই বিপ্লবে আন্তর্জাতিক যোগাযোগগুলো সম্পন্ন করেছিলাম এবং মাফিয়ার পলায়নে সেখানে আমার প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে—যা আপনি জানেন না। আমি বাংলাদেশ এবং তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ধারণ করি। জুলাইকে পণ্য মনে করি না, জুলাইকে অনুভব করি।

আমার মনে হচ্ছে, এনসিপি যেহেতু জুলাইয়ের তারুণ্যের শক্তিকে একত্রিত করতে পারেনি, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করেছে। মূলত দলটি ক্ষমতার জন্যই সব করছে এবং গত ৫৪ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাই রক্ষা করছে। আরও একটি বিষয় আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে দেখেছি—আপনার দলটি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে বিস্ময়কর রকম উদাসীন। বর্তমান সময়ে দলটি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন একটি বলয় যারা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভবকে ধারণ করে না, বরং বিদ্বেষ লালন করে।

উপরোক্ত সকল বিষয় পর্যালোচনা করে আমি এই দলের সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথচলার কোনো বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করছি না। অতএব দুঃখভরা হৃদয় ও এক বুক হতাশা নিয়ে আপনার দল থেকে পদত্যাগ করলাম।

আমরা যেমন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছি এবং তারুণ্যের যে রাজনীতি বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে দেশের জন্য কাজ করেছি—সেটির সম্ভাবনা জাগ্রত হলে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আবার একসঙ্গে রাজপথে দেখা হবে।’

সূত্র : যুগান্তর