
সম্প্রতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশবিরোধী নাশকতার অংশ বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের সর্বশেষ ঘটনা ঘটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়; বরং সুপরিকল্পিত নাশকতার অংশ।
সূত্র জানায়, প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এ ঘটনার পেছনে আমদানিসংশ্লিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ চিহ্নিত করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং তাদের দেশ ছেড়ে পালাতে না পারার বিষয়ে তাৎক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নাশকতার পরিকল্পনাকারীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দুটি- এক. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। দুই. বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের নিরুৎসাহিত করা। বিমানবন্দরের মতো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনায় এমন বড় ধরনের নাশকতা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারায় চক্রটি পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে দেশের দ্রুত বিকাশমান যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে মেট্রোরেলে নাশকতার পরিকল্পনা নিয়েছে বলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বেসরকারি এবং সামরিকসংশ্লিষ্ট স্থাপনায় স্যাবোটাজ ঘটানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা গত পাঁচদিনের মধ্যে একের পর এক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের নাশকতার প্রমাণ রেখেছে। এই ধারাবাহিকতার শুরু গত ১৪ অক্টোবর মঙ্গলবার। সেদিন ঢাকার মিরপুরের রূপনগর এলাকায় একটি কেমিক্যাল গোডাউন ও সংলগ্ন পোশাক প্রিন্টিং কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১৬ জন পুড়ে অঙ্গার হন এবং অনেকে দগ্ধ হন। কেমিক্যাল গোডাউনে রাসায়নিক দ্রব্য থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়।
এর রেশ কাটতে না কাটতেই ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) ‘অ্যাডামস ক্যাপ অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড’ নামে একটি কারখানায় আগুন লাগে। দুপুর ২টার দিকে লাগা ওই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ২৩ ইউনিট ও সেনা-নৌবাহিনীকে ১৭ ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টা চালাতে হয়। ওই অগ্নিকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয় এবং কারখানার ৯ তলা ভবনের আরসিসি কলামগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ধারাবাহিক নাশকতার সর্বশেষ শিকার দেশের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত শাহজালাল বিমানবন্দর। গতকাল শনিবার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি সেকশনের বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসের কার্গো শাখায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। ফলে বিমানবন্দরের উড়োজাহাজ ওঠানামা সাময়িক স্থগিত করতে হয়, যা দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলে। কার্গো ভিলেজের আমদানি পণ্য, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ও মেশিনারিজ পুড়ে বিপুল আর্থিক ক্ষতি হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে ২৫ আনসার সদস্য আহত হন।
এ ঘটনার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা এখনো তৎপর। সম্প্রতি দেশে কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনে আগুন লাগার ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত বলে জনগণ বিশ্বাস করে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে চক্রান্তের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এটি চক্রান্তের একটি অংশ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, একই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু হওয়ায় এবং অগ্নিকাণ্ডের ধরন দেখে বোঝা যায় এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। এ চক্রের মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন, বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে অস্থিরতা তৈরি করা।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো জানতে পেরেছে, ষড়যন্ত্রকারীরা কেবল বিমানবন্দরেই থেমে থাকতে চায় না; তাদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে মেট্রোরেলকে বেছে নেওয়া হয়েছে। মেট্রোরেল দেশের আধুনিক পরিবহনব্যবস্থার অন্যতম প্রতীক। এর ওপর হামলা হলে জনগণের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হবে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট অন্য একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের পতনের পর দলটির বহু নেতা দেশ থেকে পালিয়ে যান। তাদের পরিকল্পনা ছিল গত আগস্টে ব্যাপক নাশকতার মাধ্যমে দেশে ফেরা। ওই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় তারা অক্টোবর-ডিসেম্বর মাসকে টার্গেট করে নাশকতায় নেমেছেন। এ বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বাহাউদ্দিন নাছিম, মাহবুব-উল আলম হানিফ, নওফেল, জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কয়েকজন নেতা সমন্বয় করছেন বলে জানা গেছে। তারা কলকাতায় মিলিত হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এখন দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার সুযোগ পাচ্ছেন। গত ১১ অক্টোবর ভারতের দিল্লিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও নওফেল শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর থেকেই দেশে ভয়াবহ তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে চক্রান্তকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারে তাৎক্ষণিক এবং সমন্বিত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কেপিআই) নিরাপত্তা আরো জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্পষ্ট করে- দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত চলছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের ওপরই নির্ভর করছে দেশবিরোধী এ নাশকতামূলক কার্যকলাপকে প্রতিহত করা এবং পরবর্তী টার্গেটগুলোয় হামলা ঠেকিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।