
ফিরে আসে কফিন, ফেরে না গল্প- এমন হাজারও গল্প রয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের। যারা নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পাড়ি দেন দূর প্রবাসে। আর সেখানেই অনেকের ভাগ্যের শেষটা লেখা হয়ে যায়। যেখান থেকে অনেকেই ফিরেন কফিনে করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে যাদের রক্তঝরা ঘাম, সেই মানুষগুলোর মৃত্যুর পরও অনেক সময় জোটে না সম্মান। সম্প্রতি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (আরএমএমআরইউ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু সংক্রান্ত এক ভয়াবহ চিত্র।
যেখানে বলা হয়- গত বছরে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছুঁয়েছে। ওই বছর ৪,৮১৩ জন অভিবাসীর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫.৭% বেশি। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘প্রবাসে মৃত শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক সংলাপে এই তথ্য তুলে ধরা হয়।
সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এতো তরুণ মানুষ কেন মারা যাচ্ছে? সরকারের উচিত প্রতিটি মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণে পোস্টমর্টেম নিশ্চিত করা। কিন্তু বর্তমানে তা করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও, মৃত্যুর সনদে একে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে যেসব প্রবাসী মারা গেছেন, তাদের গড় বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর।
বিশেষ করে, যারা আরব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রমবাজারনির্ভর দেশে কাজ করতেন, তাদের মধ্যে নারীদের মৃত্যুর গড় বয়স ইউরোপ, আমেরিকা বা অন্যান্য উন্নত দেশের নারীদের চেয়ে অন্তত ১০ বছর কম।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রবাসী নারীদের মধ্যে ৩২% মৃত্যুই ‘অস্বাভাবিক’—যার মধ্যে দুর্ঘটনা, খুন ও আত্মহত্যা অন্তর্ভুক্ত। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অনেকেই বিদেশে কাজ শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করছেন।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রবাসী মৃত্যুর ৬৯%-কে ‘স্বাভাবিক’ এবং ৩১%-কে ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, সৌদি আরবে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি ২৪%।
অস্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য শুধুমাত্র শ্রমবাজারনির্ভর দেশগুলো থেকে পাওয়া যায়। বিপরীতে, এশিয়ার যেসব দেশে শ্রমের জন্য মানুষ যায় না বা উন্নত দেশগুলো, সেসব জায়গা থেকে এ ধরনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না।
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো প্রায় ৪৮% পরিবারের সদস্য বিশ্বাস করেন না যে মৃত্যুর সনদে উল্লেখিত কারণটি সঠিক।
সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা জানান, ঢাকার বিমানবন্দরে প্রবাসী মৃতদেহগুলো গ্রহণের সময় অনেক সময় মর্যাদাহীন ও অমানবিক আচরণ করা হয়।
অধিকাংশ পরিবারকে মৃত্যুর কাগজপত্র সংগ্রহে নানা ধরনের জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় প্রায় ৮০% পরিবার এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
‘কেন এত মানুষ, বিশেষ করে এত তরুণ, অল্প সময়েই বিদেশে গিয়ে মারা যাচ্ছেন—এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাচ্ছি না’, বলেন তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যুর কারণ নিরূপণের জন্য যথাযথ তদন্ত ও সম্মানজনক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।’
এই প্রতিবেদনটি প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন ও মৃত্যুর গল্প তুলে ধরছে— যাদের পরিশ্রমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, অথচ তাদের মৃত্যুর পরও অনেক সময় সম্মানটুকু নিশ্চিত হয় না। এখনই সময়, রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষ থেকে প্রবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হওয়ার।