অপরাধ: ছাগলকাণ্ডে সব হারানো প্রতাপশালী মতিউর রহমান এখন আশ্রয় খুঁজছেন। ক’দিন আগেও তিনি ছিলেন অনেক রাঘব-বোয়ালদের প্রশ্রয়দাতা ও অভিভাবক। অথচ তিনি নিজেই এখন আশ্রয় চেয়ে অন্যের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। ফোন কলের মাধ্যমে তিনি যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এরই মধ্যে তাদের তালিকা বের করেছে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক, একাধিক মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং কিছু রাজনীতিবিদের নাম রয়েছে। এছাড়া এর আগে মতিউর রহমান যেসব রাঘব-বোয়ালদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন তাদের তালিকাও করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, আশ্রয় চেয়ে মতিউর রহমান যাদের ফোন দিচ্ছেন তাদের কেউ সহায়তা করার সম্মতি দিয়েছেন। আবার কেউ ‘এই মুহূর্তে কিছুই করতে পারবেন না’ বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
ছাগলকাণ্ডে নাম আসার পর দুদকের অনুসন্ধান কমিটির পাশাপাশি মতিউরের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।
দুর্নীতি দমন কমিশনসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে, স্ত্রী, সন্তান-কন্যার বাইরে দূরসম্পর্কের স্বজনদের নামেও সহায়-সম্পত্তি গড়েছেন মতিউর। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী ও ছেলে ইফাত বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
মতিউরের সব ধরনের সম্পদের তালিকা প্রায় চূড়ান্ত করেছে দুদক। চলতি সপ্তাহেই সম্পদগুলো ক্রোক ও ফ্রিজ করতে আদালতে আবেদন জানানো হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন যাতে না করতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, মতিউরের আয়কর ফাইলে দেখানো আয়-ব্যয় ও সম্পদের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তার ট্যাক্স ফাইলে উল্লিখিত সম্পদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মতিউর। স্ত্রী ও সন্তানদের বাইরেও দূর সম্পর্কের স্বজনদের নামেও তিনি সম্পদ করেছেন।
সূত্র আরো জানায়, মতিউরের আয়কর নথি তলব করা হয়েছে। আয়কর নথি অনুযায়ী তার ২০ কোটির বেশি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে নগদ দেখানো হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে দেখানো হয় ৮২ লাখ টাকার বিনিয়োগ। ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, ৩ কোটি টাকার অকৃষি সম্পত্তি এবং একটি মৎস্য খামারে ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার তথ্য আছে তার ফাইলে। তবে আয়কর নথিতে তার আর কোনো সম্পত্তির কথা উল্লেখ নেই।
মতিউরের বিরুদ্ধে এর আগে চারবার অনুসন্ধান করে দায়মুক্তি দিয়েছিল দুদক। যারা ঐ সময় তদন্ত করেছিলেন, তাদের বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
এনবিআর ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যাদের সঙ্গে মতিউর কথা বলেছেন, তাদের ফোনলিস্ট পাওয়া গেছে। তিনি এখন আশ্রয়দাতা খুঁজছেন। অথচ এক মাস আগেও তার আশ্রয়ে ছিলেন অনেক রাঘববোয়াল। তাদের বিষয়েও তার খোঁজ নিচ্ছেন।
মতিউরের প্রথম স্ত্রীর যত সম্পদ-
দুদক সূত্র জানায়, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যাওয়া মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকীর নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদ থাকার তথ্য রয়েছে আয়কর নথিতে।
২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর বিবরণীতে মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজ মোট সম্পদ দেখিয়েছেন ১০ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা। হাতে এবং ব্যাংকে নগদ ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আছে বলে উল্লেখ করেছেন। পুঁজিবাজারের শেয়ার বিক্রি থেকে ১ কোটি ৬৮ লাখ ৯৩ হাজার টাকা মুনাফার কথাও বলা হয়।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে তার প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও ৫টি ফ্ল্যাট আছে। এর মধ্যে ঢাকার মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট।
আয়কর ও নির্বাচনী হলফনামার নথি অনুযায়ী, বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্ট-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে বছরে তার আয় ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কৃষি খাত থেকে আয় ১৮ লাখ টাকা। শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে আসে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সম্মানী পান ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৭৫ টাকা। ব্যাংকের সুদ থেকে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৩৯ টাকা আয় করেন। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
কৃষিজমির পরিমাণ ১৫৪ শতাংশ। অকৃষি জমির মধ্যে রয়েছে রাজউকে পাঁচ কাঠার প্লট, সাভারে সাড়ে ৮ কাঠার জমি, গাজীপুরে ৫ কাঠা, পুবাইলে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২ দশমিক ৯০ শতাংশ, পুবাইল থানার খিলগাঁও মৌজায় ৫ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, গাজীপুরের বাহাদুরপুরে ২৭ শতাংশ, গাজীপুরের মেঘদুবীতে ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, গাজীপুরের ধোপাপাড়ায় ১৭ শতাংশ, নরসিংদীর রায়পুরায় ৩৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ, রায়পুরার মরজালে ১৩৩ শতাংশ, সোয়া ৫ শতাংশ, ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ, শিবপুরে ২৭ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, শিবপুরের যোশরে সাড়ে ৪৪ শতাংশ ও নাটোরের সিংড়ায় ১ একর ৬৬ শতাংশ জমি রয়েছে।
জানা গেছে, কলেজ শিক্ষক লায়লা কানিজ বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক।
কানাডাপ্রবাসী কন্যা ইপ্সিতার শতকোটি টাকার সম্পদ-
২০২৩-২৪ করবর্ষে মতিউর কন্যার আয়কর ফাইলে ৪২ কোটি টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছে। সোনালী সিকিউরিটিজে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সিনাজি ট্রেডিং লিমিটেডে ৫ লাখ টাকা, গ্লোবাল সুজ কোম্পানিতে ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৫৫ হাজার, ওয়ান্ডার পার্কে ১০ লাখ ও মামুন অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস কোম্পানিতে ৪৫ লাখ ৪৫ হাজার ৬৯০ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে ইপ্সিতার।
বিভিন্ন স্থানে ঋণ ও ধার বাবদ ইপ্সিতার সম্পদ আছে ২২ কোটি টাকার। নরসিংদীতে হেবামূলে দেড় একর জমি আছে তার। বারিধারায় আছে বিলাসবহুল সাততলা বাড়ি। আয়কর নথিতে সেটি দেখানো হয়েছে ৫ কোটি টাকার সম্পদ।
মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রীর যত সম্পদ-
মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানদের নামেও আছে বিপুল সম্পদ। দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে ধানমন্ডিতে একটি, লালমাটিয়ায় একটি, কাকরাইলে দুটিসহ আরও বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পুঁজিবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন। আরও আছে পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে এসকে থ্রেড নামে সুতা তৈরির কারখানা ও টঙ্গীতে এসকে ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামের গার্মেন্টস সরঞ্জাম তৈরির কারখানা।
দুদকের অনুসন্ধান দলের একজন কর্মকর্তা বলেন, আয়কর নথিসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাথমিকভাবে মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের যেসব সম্পদ আছে, সেগুলোর তালিকা করা হয়েছে। এসব স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করার নির্দেশনা চেয়ে কমিশনে আবেদন করা হবে। তারপর এসব সম্পদ দেখাশোনা করার জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |