
কারো পছন্দ হোক বা না হোক ৯ সেপ্টেম্বর সেকেন্ড পার্লামেন্ট খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামি ছাত্র শিবিরের ভূমিধস বিজয়ে প্রমাণ হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে শিবিরের হাত অনেক লম্বা। আরও প্রমাণিত হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে ইসলামি ছাত্র শিবিরের পিতৃ সংগঠন জামায়াতের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ।
তাই নীতি বা কৌশল অথবা অপকৌশল সব দিকের সংমিশ্রণের ফলাফল হল ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের নিরঙ্কুশ বিজয়। যে ফলাফলে সাধারণভাবে পর্যবেক্ষকরাও বিস্মিত ,হতভম্ব বা হতচকিত হয়ে পড়েছেন।
এখন চলছে বিচার বিশ্লেষণ কেন ছাত্রদল হারলো , এই হারের প্রভাব কী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে ? নাকি অতীতে জাসদ ও বাসদের ডাকসাইটে নেতা আক্তারুজ্জামান বা মাহমুদুর রহমান মান্নার বিজয়ের মত জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব বহন করবেনা?
উপরোক্ত বিচার্য বিষয়ের আলোকে নির্বাচনী ফলাফলে প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে চলে আসে সেটা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সহ নিয়ন্ত্রক প্রতিটি চেয়ার ছাত্র / ছাত্রী হলে, ক্যান্টিনে শিবিরের অদৃশ্য লম্বা হাতের নিয়ন্ত্রণ। শিবির এই নিয়ন্ত্রণের কাজটা শুরু করে ১/১১ এবং তৎপরবর্তী আওয়ামী শাসনামলে। ১/১১ এর দুই বছরে সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশে ছাত্র / ছাত্রী হলগুলোতে দাওয়াতি কার্যক্রম জোরদার করে হলে হলে শিবিরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ফেসিস্ট শাসনকালে যখন ছাত্রলীগের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয় তখন শিবিরের সমর্থক, কর্মী এমনকি সাথী ও সদস্য পর্যায়ের জনশক্তি ছাত্রলীগের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শিবিরের এই গুপ্ত রুপ শুধু আত্মরক্ষা বা টিকে থাকার স্বার্থেই ছিলোনা ছিলো ছাত্রলীগ হিসেবে সব রকম নৈতিক / অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার মেটিকুলাস ডিজাইন হিসেবে।
ছাত্রলীগ নেতৃত্ব বিষয়গুলো যে একেবারেই বোঝেনি তা হয়তো নয় বুঝেও তাদের চুপ করে থাকতে হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে প্রতিহত করার স্বার্থে। ফেসিস্ট শাসনকালে সব গণ-আন্দোলনে যে হেলমেট পরা বাহিনীর ব্যবহার হয় সেই বাহিনীর শারীরিক দক্ষতা থেকে অনেকেই ভাবতেন এরা হয়তো গুপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর বাহিরে যে অন্য গুপ্ত পরিচয়ে কাজটা করতে পারে সেটা কারো মাথাতেই আসেনি। অবশ্য এরা যে শিবির সেটা নাও হতে পারে। আবার হতেও পারে। বিষয়টা রাজনীতির, রণকৌশলের।
এইসব নেগেটিভ বিষয়ের বাইরে একটা ছাত্র সংগঠনের, গঠন, বিকাশ ও প্রসারের জন্য যে উপাদানগুলো দরকার তার সবই আছে শিবির বা শিবির সংক্রান্ত নেটওয়ার্কের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সহযোগিতা, ভর্তি পরবর্তী সময়ে মফস্বলের আগত একজন শিক্ষার্থীদের আবাসন, প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে পড়ানোর সুযোগ এবং লজিং এর বব্যস্থা করে দেওয়ার মত মানবিক কাজগুলো আর কে করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা, নোট সরবরাহ ইত্যাদি জরুরি কাজগুলো শিবির যেভাবে ছাত্র ছাত্রীদের যে সুবিধা দেয় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ বা বড়ো সংগঠন ছাত্রদল কী সেগুলো করে?
৭১ বিলুপ্ত ইসলামি ছাত্রসংঘ স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামি ছাত্রশিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তিনযুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে করে আসছে তারই একটা ভালো ফল পেয়েছে নবনির্বাচিত ভিপি সাদিক কাইয়ুম ও জি এস এম ফরহাদ। সদ্য ঘোষিত নির্বাচনে ভিপি পদে তাই সাদিক কায়েম প্রতিপক্ষকে তিনগুণ এবং এবং জিএস পদে এস এম ফরহাদ প্রতিপক্ষকে দ্বিগুণ ভোটের ব্যবধানে হারাতে পেরেছেন।
বিদ্যমান উপরোক্ত বাস্তবতা ছাড়াও ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে ছাত্রদের নামাজি হিসেবে গড়ে তোলা এবং ছাত্রীদের হিজাবের পক্ষে ধারাবাহিক সংগ্রাম ও চেষ্টা অন্যদের তুলনায় আলাদা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে শিবিরকে। এই ক্ষেত্রে শিবির ছাত্র ছাত্রীদেও পাশাপাশি অভিবাবকদেও মন জয় করতে পেছে। এই জায়গাটায় কিন্তু যোজন যোজন পিছিয়ে আছে আছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সহ অন্যরা।
ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভূমিধ্বস বিজয়ে ছাত্রলীগের একাংশ শত্রুর শত্রু হয় মিত্র এই ইকুয়েশনে তাদের ভোট দিয়েছে শিবিরকে। একাংশ নিরাপদভাবে ক্যাম্পাসে অবস্থানের গোপন গ্যারান্টিতে ভোট দিয়েছে শিবিরকে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের খাবার, দোকান, বইপু¯তক, খাতা-কলম ও ফটোকপির দোকানগুলোর মালিক বা শ্রমিকরা এই নির্বাচনে শিবিরের পক্ষে যে সূক্ষ্ম প্রচারণা চালিয়েছে সেটা শিবিরের বিজয়ে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
ইসলামি ছাত্রশিবিরের বিজয়ে আরেকটা ফ্যাক্টর কাজ করেছে। সেটা হল অনলাইন ও ভার্চুয়াল জগত। পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস হোসেন, কনক সারোয়ার, মিনা ফারাহ, প্রিসিলা, বনি আমিন প্রমুখ বর্তমানে জামায়াত ও শিবিরকে আনকন্ডিশনাল সাপোর্ট দিয়েছে। এর বাইরে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি অনলাইন প্লাটফর্ম শিবিরের পক্ষে এবং বিএনপি ও ছাত্রদলের বিপক্ষে দিনরাত প্রচারণা চালিয়েছে। যার সুফল পেয়েছে শিবির আর কুফল পেয়েছে ছাত্রদল।
এছাড়া শিবিরের পক্ষে ভূমিকা পালনের বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সমর্থক সব শিক্ষক / কর্মকর্তা / কর্মচারী কোন রাখঢাক না করলেও বিএনপি সমর্থক শিক্ষক / কর্মকর্তা / কর্মচারীদের ভূমিকা ছিলো সম্পূর্ণ তার বিপরীত। মুলত এসব কারণে শিবিরের ভূমিধস জয় এবং ছাত্রদলের পরাজয়ে আসলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বাস্তবতা হল এক এগারো থেকে টানা ১৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দল গোছাতেই পারেনি । ৫ আগস্টের পরবর্তী সময়েও ছাত্রদল সংগঠন গোছাতে মনোযোগী ছিলনা । হয়তো ভেবেছিল দল আগে ক্ষমতায় আসুক তখন দেখা যাবে। এর পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরের এই বিজয় কিন্তু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা । অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজেও এর প্রভাব পড়বে।
অবশ্যম্ভাবীভাবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে । কারণ আপতত কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ আওয়ামীলীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কমন শত্রু বিএনপি ও ছাত্রদল। আওয়ামীলীগ জানে শত্রুর শত্রু হিসেবে তাদেও জন্য বিএনপির চেয়ে জামাতই তাদের ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ। জামাত ইসলামি একটি ধর্মীয় আদর্শিক দল হলেও এর একটা একটা এনজিও প্যাটার্ন রয়েছে তাই তারা জেনারেল ইয়াহিয়া , জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মইন এমনকি আওয়ামী লীগকেও সাপোর্ট করতে সংকোচ করেনি।
আবার ১৯৯১ সালে ও ২০০১ সালে বিএনপিকে সাপোর্ট দিয়েছে । ধারণা করা হয় ১৯৯৬ সালে জামাত আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট দিয়ে আন্দোলন না করলে বা এককভাবে তিনশ আসনে প্রার্থী না দিলে ওই বিএনপি হয়তো এককভাবেই ক্ষমতায় যেতো অথবা নিজেদের সিট সংখ্যা বেড়ে ২৫ টা হতো হয়তোবা সরকার গঠনের জন্য বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে জামায়াতের শরণাপন্ন হতে হতো। ফলে আগামী নির্বাচনে ডাকসু নির্বাচনের ফল অতিতের মত জাতীয় রাজনাতির জন্য গুরুত্ব বহন করবেনা তা নাও হতে পারে।
ডাকসু নির্বাচনে জামায়াত , শিবির , নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ , কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে বহিঃশক্তির একটা খেলা সংশ্লিষ্ট আছে। এই খেলা রাজনীতির খেলা। খেলাটার শুরু ডাকসু দিয়ে হলেও খেলোয়াড়রা নিশ্চিতই এটাকে ‘বিএনপি ক্রাশ’ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইবে তাতে সন্দেহ করা ঠিক হবেনা।
সূত্র: ইনকিলাব










































