প্রচ্ছদ জাতীয় ডলার সংকট, বাজারে বড় ধাক্কা

ডলার সংকট, বাজারে বড় ধাক্কা

ডলারের সংকট দীর্ঘদিনের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানিতে লাগাম টানা হয়েছে। এতে কমেছে অনেক পণ্যের আমদানি। যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। দেশে ব্যবহৃত প্রসাধনী সামগ্রির একটি বড় অংশ আসে বিদেশ থেকে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও ডলার সংকটের কারণে প্রসাধনীর অভ্যন্তরীণ বাজারে বড় ধাক্কা লেগেছে। আমদানি কমায় দাম বেড়েছে দেশের বাজারে। দাম বাড়ায় আবার বিক্রি কমে গেছে অনেক পণ্যের। এছাড়া আমদানি-নির্ভর উপাদানে দেশে উৎপাদিত পণ্যেরও দাম বাড়ছে। এতে ক্রেতারা পড়েছেন বিপাকে।

পরিস্থিতির কারণে আমদানিকারকদের কেউ কেউ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ কর্মীসংখ্যা কমিয়েছেন।

প্রসাধনী ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ সময় ধরে সংকট যাচ্ছে। দিন দিন এই সংকট আরও বাড়ছে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে তারা পণ্য ক্রয় করতে পারছেন না। ফলে দোকানে নতুন পণ্যের সরবরাহ কম। চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছেন না ক্রেতাদের। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বিকল্প উপায়ে পণ্য আনা হলেও এর দাম পড়ছে বেশি। এদিকে আমদানিকারকরা বলছেন, ডলার সংকট, পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং এলসি খুলতে না পারায় তারা প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না।

সরজমিন রাজধানীর চন্দ্রিমা, গাউছিয়া, চাঁদনী চক, চকবাজার নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রসাধনী বিক্রি হয় এমন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে দাম বাড়ায় পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে। বিদেশি পণ্যের সরবরাহও কম। বিকল্প উপায়ে কিছু কিছু প্রসাধনী আনা হলেও এর দাম পড়ছে বেশি। ডলার সংকটের আগে লাগেজে করে ৩০ শতাংশ আর আমদানিকারকরা ৭০ শতাংশ পণ্য আমদানি করতেন। বর্তমানে ৮৫ শতাংশ প্রসাধনী ব্যবসায়ী লাগেজের পণ্যের উপর নির্ভরশীল।

নিউ মার্কেটের নিকাব কসমেটিকসের দোকানি নূরুল আমিন বলেন, আমদানিকারকদের কাছ থেকে কোনো পণ্য কিনতে পারছি না। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে বর্তমানে পণ্য রাখা হচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদামতো পণ্য দিতে পারছি না। অনেক ঘাটতি থেকে যায়। জিনিসের দামও অনেক বাড়তি। অধিকাংশ ক্রেতা আমদানিকৃত পণ্যগুলো চায়। ডলার, ভ্যাট, ট্যাক্সের কারণে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। সব সমস্যার মূল- ডলার সংকট। দু’-একদিন পরপর ধাপে ধাপে দাম বেড়ে যাচ্ছে। ৮৫ শতাংশ কসমেটিক্স ব্যবসায়ী বর্তমানে লাগেজের পণ্যের উপর নির্ভরশীল। প্রায় এক বছর ধরে লাগেজ ছাড়া আমাদের পণ্য আনার কোনো উপায় নেই। আমদানিকারকরা বলেন, ডলার নেই, এলসি নেই। আগে দোকান জিনিসে পরিপূর্ণ থাকতো কিন্তু এখন মানুষের যেটা প্রয়োজনীয় সেটিই দোকানে রাখতে পারছি না।
আমদানিকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে ডলার ১২৫ টাকা করেও পাওয়া যাচ্ছে না। গত কয়েক মাসে এলসি করার মতো কোনো অবস্থা নেই। আমরা কসমেটিকসের কোনো আইটেমই পাচ্ছি না। অন্যান্য পণ্যের কিছু এলসি পেলেও সেটিও খুব দেরি হচ্ছে। আরেকটি বিষয় হলো- বন্দরে হয়রানি।

তিনি বলেন, বিগত ছয় মাসে আমরা কোনো এলসি করতে পারিনি। এর আগে কোভিডে আমরা অনেক ক্ষতিগস্ত হয়েছি, ২০২০-২০২১ সালে আমরা কোনো মার্কেটিং-ই করতে পারিনি। এবং ২০২২ সালে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি সেটিও হয়নি। ডলার সংকটের কারণে একদম খারাপ অবস্থা। প্রত্যেকটি পণ্যের দাম বাড়ছে।

২০১৯ সালে আমাদের প্রতিষ্ঠানে সাড়ে চারশ’ লোক ছিল। যারা বিভিন্ন জেলা-থানা লেভেলে কাজ করতো। বর্তমানে সেখানে এক-দেড়শ’ লোক নেই। আগে এক সময় প্রচুর আমাদানিকৃত পণ্য বিক্রি ছিল কিন্তু সেটি তো এখন আর করতে পারছি না। আমাদের ষোলতলা ভবনে প্রত্যেক ফ্লোরে বেশকিছু আমদানিকারক কোম্পানি ছিল এখন সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে কারণ তারা ইমপোর্ট করতে পারছেন না।

চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের লুবানা ইমপেরিয়ামের আমদানিকারক তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দোকানে সব চায়নিজ প্রডাক্ট। ডলার সংকট তো অনেক আগে থেকে রয়েছে। আগে এলসি করতে ৫০ শতাংশ টাকা দিলে হতো এখন পুরো টাকা দিতে হয়। আগে ১০০ আইটেম দিয়ে কন্টেইনার করা যেতো কিন্তু এখন ৪-৫টি আইটেম দিয়ে করতে হচ্ছে। পণ্য সংকট তো রয়েছেই। তিন মাস অন্তর অন্তর টাকা দিতে হচ্ছে, আগে এক বছরে টাকা দিলেই হতো।

বিশ্বাস বিল্ডার্স নিউ মার্কেট সিটি কমপ্লেক্সের দোকনি মো. সুজন বলেন, আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করা হয় সব সময়। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে আমাদের অনেক বড় সমস্যা হচ্ছে। এলসি খোলার জন্য যারা ব্যাংকে যাচ্ছে তাদের সেখানেও হয়রানির শিকার হতে হয়, সেই সঙ্গে ঘুষও দিতে হয়। এলসি পাওয়ার পরেও ডলার সংকটের কারণে তারা পণ্য ইচ্ছামতো আনতে পারে না।

গাউছিয়া মার্কেটের মাহমুদ’স কসমেটিকসের বিক্রেতা বলেন, আমরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করি। সব পণ্যের দাম তো আগে থেকেই বাড়তি। আমদানিকারকরা সবসময় ডলারের দাম বাড়ার কথা বলে। সরকার ভ্যাট বাড়িয়েছে, নানান অজুহাত তাদের। এখন আমরা কী করবো। একটা ফেসওয়াস ১৫০-২০০ টাকায় বিক্রি করেছি সেটি এখন ৩৬০ টাকা আমদানিকারকদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে। যে পারফিউম ২৫০ টাকায় বিক্রি করেছি সেটি কোম্পানিদের দেয়া মূল্য ৫৩০ টাকা। প্রত্যেকটি পণ্যের দাম নাগালের বাইরে। দোকান চালাতে হলে পণ্য আনতে হবে সেভাবে আনছি। বর্তমান যে অবস্থা তাতে মানুষ আগে খেয়ে বাঁচতে চাইছে। তারপর প্রসাধনী ব্যবহার। অর্ধেক ক্রেতা কমেছে প্রসাধনীর বাজারে। আমরাও চাহিদামতো দোকানে পণ্য রাখতে পারছি না।

বাংলাদেশ কসমেটিক্স অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিসিটিআইএ) কোষাধ্যক্ষ শাহ্ জামান কাজী বলেন, সমস্যা তো অনেক ভয়াবহ। কোনো কোনো ব্যাংক ছোট এলসি হলে দিচ্ছে, বড় এলসি হলে দিচ্ছে না। ডলারের দামও এক এক ব্যাংকে একেক রকম। দুই বছর ধরে এমন অবস্থা দেখা যাচ্ছে কোনো উন্নতি হচ্ছে না। পণ্য সংকট থাকার কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর ডলারের কারণে তো সমস্যা আছেই। পণ্য দরকার আমার ১ হাজার পিস এখন সেখানে যদি ৫০০ পিস আসে সেক্ষেত্রে ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী দিতে পারছি না। পণ্য সরবরাহ কমেছে ৫০-৬০ শতাংশ। অনেক আমদানিকারক ব্যবসা করতে পারছেন না। এলসি পর্যাপ্ত পেলে এই পরিস্থিত কিছুটা পরিবর্তন হবে। এখানে আবার কাস্টমসে অনেক আইটেমের উপরে ট্যাক্স বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই ক্ষেত্রে কনজ্যুমারের, ভোক্তার সামর্থ্য নেই ক্রয় করার।

ফেন্সি কোম্পানি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. আকতার বলেন, ১১০-১২০ শতাংশ এলসি মার্জিনটা দিতে হচ্ছে। আগে যেমন ১০ শতাংশ মার্জিন দিলেই এলসি হয়ে যেতো। এতে আমরা ইমপোর্ট করতে অনেক ভয় পাচ্ছি, সময়মতো এলসি পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্য আমদানি করতে পারছি না। ভ্যাট-ট্যাক্সের তো সমস্যা আছেই। পুরো ইমপোর্ট সেকশন টা একটা ধসের দিকে চলে যাচ্ছে। আগে এলসি’র কথা শুনলে ব্যাংক নিজেই ডাকতো যে, আপনি এলসি কেন করছেন না, আর এখন প্রেয়ার দিয়ে রাখলে ব্যাংক ৭-১০ দিন সময় দিয়ে পরে বলছে এখন ডলার সংকট, সম্ভব না বা দেয়া যাচ্ছে না।

ডারকিন ট্রেড অ্যান্ড ডিসট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া মানবজমিনকে বলেন, ডলার সংকটের কারণে এলসি হচ্ছে না আর যেগুলো হচ্ছে- সেটি ১২৫-১৫০ শতাংশ মার্জিনে। এতে করে স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ী ছিলেন যারা, ২০-৫০ লাখ বা ১ কোটি টাকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন তারা এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন আর এই স্বল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।