বাংলাদেশ: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাজী হাসিবুর রহমান ওরফে হিমেল। পরিবারের সঙ্গে বাস করেন রাজধানীর উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে। বাবার মৃত্যুর পর অনেকটা নিরুপায় হয়ে পারিবারিক ব্যবসায় নামেন এ শিক্ষার্থী। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অপহরণের শিকার হন তিনি। স্বামীর পর এবার সন্তানকে হারিয়ে নিস্তব্ধ হিমেলের মা তহুরা হক। একমাত্র সন্তানকে পেতে দ্বারস্থ হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। পরিবারসূত্রে জানা যায়, গত ২৬ ডিসেম্বর ব্যবসার প্রয়োজনে নিজস্ব প্রাইভেটকারযোগে শেরপুরের উদ্দেশ্যে বের হন হিমেল। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সঙ্গে ছিলেন চালক সামিদুল। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি। সকাল সাড়ে ৯ টায় রওনা দেওয়া কাজী হাসিবুর রহমানের মোবাইল নম্বরেও আর সংযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন মায়ের মোবাইলে হিমেলের একটি ভিডিও বার্তা আসে। তারপরই পরিষ্কার হয় হিমেলের অপহরণের ঘটনা।
ওই ভিডিও বার্তায় মাকে উদ্দেশ্য করে অপহৃত হিমেলকে ক্রন্দন কণ্ঠে বলতে শোনা যায়— “মা, মা, ও মা, ওদের ভাষা আমি বুঝি না মা। ওদের একজন শুধু বাংলায় কথা বলে মা। বাকিদের কথা শুধু বুঝি না মা। ওদের সবার কাছে অস্ত্র। কাল যদি না আসো মা, তাহলে ওরা আমার হাত-পা কেটে বাংলাদেশে ভাসায় দেবে বলছে। কাল আসো মা। ৫ থেকে ১০ মিনিট লাগবে টাকা পৌঁছে দিতে মা। কালই আসো, টাকা দিয়ে আমারে নিয়ে যাও মা।” বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানকে জিম্মির পর এভাবেই মায়ের কাছে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে মাকেও সন্তান হারানোর ভয়ে জিম্মি করার চেষ্টা করে অপহরণকারীরা। এরপর একাধিক ভারতীয় মোবাইল নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ভুক্তভোগীর মাকে ফোন দিয়ে ছেলেকে মুক্ত করতে মুক্তিপণ হিসেবে দুই কোটি টাকা দাবি করা হয়। পরবর্তীতে বলা হয়— ৩০ লাখ টাকা না দিলে সন্তানের হাত কেটে হত্যা করা হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরা পশ্চিম থানায় অপহরণের ধারায় নিয়মিত মামলা হয়।
হিমেল অপহৃত হওয়ার ঘটনায় ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি)। এ ব্যাপারে ছায়া তদন্তের পাশাপাশি অনুসন্ধানসহ অভিযানে নামে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবও। এখন ডিএমপির ডিবি লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া, নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা, সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর থানাধীন টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকায় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে স্থানীয় লোকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার দাবি করে। এখন পর্যন্ত মোট ছয়জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানালেও ভুক্তভোগী অপহৃত হিমেলকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে র্যাব জানিয়েছে— খুব দ্রুতই হিমেলকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হবে। র্যাবের একাধিক টিম অভিযানে রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার(ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, ডিজিটাল তথ্য অ্যানালাইসিস করে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পুলিশকে দিয়ে মেঘালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম খাসি হিলস জেলা ননগ্লাম থানার পাহাড়িয়া এলাকায় একাধিক অভিযানের ব্যবস্থা করে লালবাগ বিভাগ। উদ্ধার করা হয় জুতা, ব্যাগ, মোবাইল সেট এবং অনেক মোবাইল নম্বরসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত। ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্তে নিশ্চিত করে অপহরণকারী চক্রের সদস্যদেরকে। দায়ের হওয়া মামলার ছায়া তদন্তে অগ্রগতির কারণে পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে অপহরণ মামলাটি উত্তরা পশ্চিম থানা থেকে ডিবি লালবাগ বিভাগে হস্তান্তর করা হয়।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে শরীয়তপুর জেলার গোঁসাইহাট থানাধীন একটি অত্যন্ত চর থেকে আসামি মাসুদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি লালবাগের একটি টিম। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেদিন সন্ধ্যায় অপহরণ চক্রে জড়িত আসামি সামিদুলের স্ত্রী রুবিনা ও মালেকের স্ত্রী কামরুন্নাহারকে তুরাগ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিসি মশিউর রহমান আরও বলেন, পুলিশের তৎপরতার অপহৃত হিমেলের গাড়িটি এনে গাজীপুরের বাসন থানা এলাকায় ফেলে রেখেছিল মাসুদ। মাসুদের কাজ ছিল গাড়িটি ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া। এরপর আবার ঢাকায় নিয়ে এসে কোথাও রাখা। ডিসি মশিউর রহমান বলেন, আসামি মাসুদের দেওয়া তথ্য ও সুনামগঞ্জের হাওড়ের বিশ্বস্ত সোর্সের মাধ্যমে অপহরণ চক্রের চার মূল আসামিকে টাঙ্গুয়ার হাওরের একটি নৌকার মধ্যে দেখা যায় বলে জানা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি সুনামগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার, ওসি মধ্যনগর, ওসি তাহিরপুর ও টাঙ্গুয়ার হাওয়ার এলাকার টেকেরঘাট পুলিশ ফাঁড়ির আইসিকে জানানো হয়। এ সকল পুলিশ ইউনিট বিশেষ করে টেকেরঘাট থানার আইসি স্থানীয় জনতাকে সাথে নিয়ে হাওড়ের মধ্যে অভিযান চালিয়ে ৪ জন মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- আব্দুল মালেক, ড্রাইভার সামিদুল, মানিক মিয়া এবং মোবারক হোসেন। এই চারজনই মূলত অপহরণ চক্রের অন্যতম হোতা। তাদের মধ্যে মানিক ও মোবারকের ইন্ডিয়ায় নিয়মিত যাতায়াত আছে। তারাই ভারতে নিয়ে ভুক্তভোগীদের জিম্মি করে। তিনি বলেন, ডিবি পুলিশের রিকুইজিশনের প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা স্থানীয় জনতার সহযোগিতায় আসামিদেরকে গ্রেপ্তার করার অল্প সময়ের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের র্যাব সদস্যরা উপস্থিত হয়। তারা আসামি মালেক এবং সামিদুলকে নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভুক্তভোগীকে উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করছে। অপহরণকাণ্ডে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটিকে উদ্ধারসহ মূল সকল আসামিকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের(ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, পুলিশের তৎপরতার কারণে মূল আসামিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি সহসা ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিমেলকেও উদ্ধার করা সম্ভব হবে। সে চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে যোগাযোগ করা হলে র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হিমেল নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী অপহরণের ঘটনায় র্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। হিমেল অপহরণের ঘটনায় প্রকৃত জড়িতদের র্যাব শনাক্ত করেছে। অপহৃত হিমেলকে সুস্থভাবে উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খুব শিগগিরি এ ব্যাপারে জানানো হবে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী হিমেলের মামা নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত চার মাস আগে হিমেলের বাবা মারা যায়। তারপর থেকেই হিমেলের মা ভীষণ অসুস্থ ও ভেঙ্গে পড়ে। এর মধ্যেই হিমেল যখন পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরছিল তখনই এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। হিমেল অপহৃতের পর তার মা ভেঙে পড়েছেন। একমাত্র সন্তান অপহৃত। ছেলেকে ফিরে পেতে আকুল হয়ে যাচ্ছেন মা তহুরা। তিনি বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে চালক সামিদুলকে শুরু থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিল। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সেটা জানিয়েছি। ঘটনার পর থেকে সামিদুলেরও হদিস মেলেনি।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |