জাতীয়: আজ থেকে ৩ দশক আগে, ১৯৯০ সালের এই দিনে, ৬ই ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সামরিক জান্তা এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলনের পর তার পতন হয়েছিল। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সে আন্দোলনে প্রায় ৩৭০ জন জীবন দিয়েছিলেন, পঙ্গু-গুম হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। হরতাল হয়েছিল প্রায় ১ বছর ৩২৮ দিন! অবরোধ হয়েছিল ৭০ দিন। জাতীয় সম্পদ ও আর্থিক ক্ষতিও হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার।
এরশাদের এই ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে যে রক্তাক্ত সংগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা। দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এই দিনকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবেও পালন করে থাকে।
সামরিক শাসকের ক্ষমতা দখল থেকে এরশাদ পতন
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক বাহিনীর প্রধান হোসাইন মোহাম্মাদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ক্ষমতা দখল করেই সামরিক ফরমান ‘এমএলআর ৮২’ জারি করেন। এতে বলা হয়, যেকোনো ভাবে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করলে ৭ বছরের জেল। তথাকথিত এই কালো আইনে হাজারো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার হয়। ক্ষমতা দখল করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তিনি কথা রাখেননি। বরং বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। সুবিধাবাদীদের নিয়ে দল গঠন ও প্রহসনের নির্বাচন করেন।
ফলে তখন এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সকল ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ জানায়। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষও এতে যোগ দেয়। স্বৈরাচারকে মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি হয়। নানা প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে জোট-ঐক্য গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলো শেষে ৩টি জোটে ঐক্যবদ্ধ হয়। ৮, ৭ ও ৫ দলীয় জোট। আন্দোলন জোরদার করতে ৩ জোটের লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যেও ২টি জোট গড়ে ওঠে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও সংগ্রামী ছাত্র জোট। আন্দোলন আরও জোরদার করতে ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর জেহাদের মরদেহ সামনে রেখে ২৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠন করা হয়।
আন্দোলনের সময়ে জনগণ ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে থেকে চাপ আসতে থাকে এরশাদ পতন পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে। সে পরিস্থিতিতে ৩ জোটের রূপরেখা ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা প্রণীত হয়। মূলত ৩ জোটের রূপরেখা হচ্ছে স্বৈরাচার হটানোর পর ক্ষমতা হস্তান্তরের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার একটি দলিল। এই দলিলকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্ব হচ্ছে এর মূল ঘোষণা এবং দ্বিতীয় পর্বে আচরণ বিধি। এটি ৪টি ধারা ও ৮টি উপধারার একটি ছোট দলিল।
সে সময় সংগ্রামের দিনগুলো ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক। সামরিক শাসক সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। একদিকে সভা-সমাবেশ-মিছিল, মত প্রকাশসহ সব ধরনের নাগরিক অধিকার রদ করা হয়েছিল। অন্যদিকে ছাত্ররাও হয়ে উঠেছিল তার বিপরীতে প্রচণ্ড বেপরোয়া। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা, হত্যা-গুম, নির্যাতন চলছিল সমান তালে। ছাত্ররাও পদে পদে স্বৈরাচারের বাঁধার সৃষ্টি করেছিল।
এদিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই হরতাল-বিক্ষোভ চলতো। কারফিউ, সান্ধ্য আইন, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ, দুইয়ের অধিক চলাফেরা নিষেধ ছিল। সে পরিস্থিতিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়েছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে শহরের অলিগলিতে ঝটিকা মিছিল হতো। যখন তখনই বুটের খট্খট্ শব্দ, সাইরেন, হুইসেল এক মহাতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো। প্রতিপক্ষ ও পুলিশের মুখোমুখি হওয়া ছিল যেন তখন প্রতিদিনের বিষয়। এভাবেই পার হয়েছিল মাস, বছর।
এরপর ১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে এক জরুরি বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদ যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, সে প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করা।
জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এর কয়েকদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সেনানিবাসের ভেতরে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে দেশের চলমান সংকট একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং এ সঙ্কট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা আরো সিদ্ধান্ত নিলেন যে চলমান রাজনৈতিক সংকটে সেনাবাহিনীর করনীয় কিছু নেই। এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সেনা সদরকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে দেশে সামরিক আইন জারী করা হবে।
এরপর ডিসেম্বরের তিন তারিখে তখনকার সেনা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে দেখা করতে যান।
এদিকে সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন যে সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নূর উদ্দিন যেন প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগের জন্য সরাসরি বলেন।কিন্তু সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি পদত্যাগের কথা না বললেও তিনি জানিয়ে দেন যে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা কোন দায়িত্ব নিতে রাজী হচ্ছে না।
তখন ঢাকা সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। অবশেষে জেনারেল চৌধুরী (সেনাপ্রধান) প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন আপনার উচিত হবে বিষয়টির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করা। অথবা বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেয়া।” সে সময় জেনারেল এরশাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক শাসন জারীর বিষয়ে সেনাবাহিনী একমত নয় বলেও প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল চৌধুরী।
প্রেসিডেন্টের সাথে সেনাপ্রধানের বৈঠক নিয়ে তখন দেশজুড়ে নানা গুঞ্জন। একদিকে ক্যান্টনম্যান্টের ভেতরে নানা তৎপরতা অন্যদিকে রাস্তায় এরশাদ বিরোধী বিক্ষোভ। সব মিলিয়ে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।
ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি বলেন যে তার পদত্যাগ করা উচিত।”পদত্যাগের কথাটা জেনারেল সালামই প্রথম সরাসরি বলেন। অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। আর্মি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে,” বলছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।
জরুরী অবস্থা এবং কারফিউর মতো কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমেওে যখন গণআন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না তখন সেনাবাহিনীর দিক থেকে নেতিবাচক মনোভাব দেখলেন মি: প্রেসিডেন্ট এরশাদ।
এমন অবস্থায় ডিসেম্বরের চার তারিখ রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেনারেল এরশাদ। তখন এরশাদ সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন মওদুদ আহমেদ. যিনি বর্তমানে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা। মি: আহমেদ জানালেন সেনাবাহিনীর মনোভাব বোঝার পরেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি মি: এরশাদ।
এরপর ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে তখনকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমেদকে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার জন্য বাংলাদেশে টেলিভিশনে পাঠিয়েছিলেন মি: এরশাদ। তবে উদ্দেশ্য ছিল, প্রেসিডেন্টের পরিকল্পিত নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা।
কিন্তু বিরোধী দলগুলো এ নির্বাচনের প্রস্তাব আগেই বর্জন করেছিলো, তবুও মি: এরশাদ চেয়েছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরার মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মি: এরশাদের নির্দেশ মতো ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ সন্ধ্যার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে গিয়েছিলেন ভাষণ রেকর্ড করার জন্য। সে ভাষণ তিনি রেকর্ডও করেছিলেন। তবে সে ভাষণ রেকর্ড করার পর মওদুদ আহমদ যখন বাসায় ফিরে আসেন তখন তিনি জানতে পারেন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এরপর কয়েক ঘন্টা পর মধ্যরাতে মওদুদ আহমেদকে আবারো বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা দেবার জন্য।
ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘৫ তারিখে বিরোধী দল থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসলো যে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সাহেব উপ-রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে তারপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাজ করবেন তিনি এবং তার অধীনেই একটি নির্দলীয় সরকার হবে।
তিনি বলেন, ‘৬ তারিখ বিকেল তিনটায় আমি রিজাইন করলাম। আমি রিজাইন করার পরে সাহাবুদ্দিন সাহেবকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যাপয়েন্ট করলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব। তারপর প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজে রিজাইন করলেন এবং তারপর সাহাবুদ্দিন সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু করলেন।’
উল্লেখ্য, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বিভিন্ন সময় ছন্দপতন হয়েছিল। তবে ১৯৮৭ সালে একটি মিছিলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হবার ঘটনা আন্দোলনে গতি এনেছিল। তবে ১৯৯০ সালের ২৭শে নভেম্বর চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনকে হত্যার পর আন্দোলনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।
এই বিষয়ে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিএনপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের নেতা খায়রুল কবির খোকন বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে দখল করার জন্য বহিরাগত মাস্তানরা পরিকল্পিতভাবে ডা: মিলনকে হত্যা করেছিলো তখন। এটা ছিল আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট, “।
ডা: মিলন যখন রিক্সায় করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ডা: মিলনের সাথে একই রিক্সায় ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের তখনকার মহাসচিব ডা: মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
অভিযোগ রয়েছে জেনারেল এরশাদ সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল চেষ্টার অংশ হিসেবে ডা: মিলনকে হত্যা করেছিলো তখন।
সূত্র : সময়ের কণ্ঠস্বর
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |