
আমীরে জামাতের বক্তৃতা দেয়ার এই ছবিটি আমার নিজ হাতে তোলা। হ্যাঁ, আমি গিয়েছিলাম আজকের জনসমুদ্রে। কোন কর্মী বা সমর্থক হিসেবে নয়। গিয়েছি আমার কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। ঠিক যেমনটা গিয়েছিলাম ৫ আগস্টের পরপর বিএনপির সমাবেশে।
২৪ এর জুলাইয়ে পুলিশের মার খেয়ে আমার ডান হাতে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে যায়। ব্যথা পাইনি, কারণ চারপাশের পরিস্থিতি বলে দিচ্ছিলো সরকার পরিবর্তন হবেই। সেই কালো দাগ নিয়ে ৫ আগস্টে মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়েছি। তবে শঙ্কা একটা ছিলো। সরকারকে না হয় পরিবর্তন করা গেলো কিন্তু রাজনীতির ধরণ কি বদলাবে? নাকি সেই পুরনো গৎবাঁধা নিয়মে চলবে??
উত্তর খুঁজতে যেদিন বিএনপির সমাবেশে গেলাম, নতুনত্ব পেলাম শুধু ভিডিও কলে বক্তৃতা। কর্মীরা সেই আগেরমত তাদের পারিশ্রমিক নিতে ব্যস্ত। সমাবেশে কি বলা হচ্ছে না হচ্ছে তাদের সেদিকে খেয়াল নেই। মঞ্চে গিজগিজ করছে মানুষ। যখনই কোন বক্তা মাইকের সামনে দাঁড়ান, তখনই তার চারপাশে ঘিরে থাকে কিছু লোভী অপরিচিত মুখ। নিজের থোৎমা দেখিয়ে যদি কিছু ফায়দা হয় এই আশায়। প্রত্যেক নেতার সেই আগের মত আলাদা আলাদা গ্রুপ,পোস্টার, ব্যানার; জায়গা নিয়ে কামড়াকামড়ি। আর জায়গা হলো সেই চিরাচরিত জনগণের রাস্তা। অমনোযোগী কর্মীদের উপর পাতিনেতাদের গায়ে হাত দেয়া তো চলছেই। এমন গৎবাঁধা মাহফিল দেখে বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি।
আজ একই প্রশ্নের উত্তর পেতে চলে গেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। খিলগাঁও থেকে আমি রমনা থানা পর্যন্ত রিক্সায় আসতে পেরেছিলাম। তারপর লোকে লোকারন্য। মিন্টু রোডের কাছেই দেখলাম বিশাল স্ক্রীনে একে একে বক্তার বক্তৃতা দেখানো হচ্ছে। সবাই সেটা শুনছেন এবং রিএক্ট করছেন। মৎস্য ভবন থেকে আর সামনে আগাতে পারলাম না। কোনমতে রমনা পার্কে ঢুকে দেখি সেটাও পূর্ণ। গতকাল রাতে আসা অনেকেই গাছের নিচে পলিথিনের উপর শুয়ে আছেন। বাড়ি থেকে আনা খাবার খাচ্ছেন। কিছু বান্দা গরম সহ্য করতে না পেরে রমনার লেকে নেমে গোসল করছেন। পুরো রমনা ভরা মানুষ কিন্তু তার মধ্যে কোন পুলিশ দেখলাম না। আর পুলিশের দরকারও ছিলো না। সবাই ছিলো সুশৃঙ্খল।
অনেক কষ্ট করে শিশুপার্কের ভেতর দিয়ে আমি উদ্যানে গেলাম। গাছের ছায়ার নিচে বসে মানুষ বিশাল স্ক্রীনে বক্তব্য শুনছে। শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলাদা করে লাগানো হয়েছে ১২ টা বিশাল স্ক্রীন। মঞ্চের স্ক্রীন তো আছেই। খাবার পানি, ওযুর পানি, অস্থায়ী ওয়াশরুম, মেডিকেল বুথ, নামাজ আদায় করার জন্য ত্রিপল, সবকিছুর ব্যবস্থা করা!! পুলিশ উদ্যানের প্রবেশমুখে থাকলেও পুরো উদ্যানে ভেতরে শুধু স্বেচ্ছাসেবকরাই ছিলো। লাখ লাখ মানুষ। কাউকে অমনোযোগী পাওয়া যায় নি। স্বেচ্ছাসেবকরা কাউকে আঘাতও করেননি।
জামায়াত ইসলামী ব্যতীত কোন নেতার ব্যক্তিগত কোন ছবি, পোস্টার দেখা যায়নি। আমার মত মাথায় দেশের পতাকা বাঁধা তরুণ দেখলাম অসংখ্য। বিভিন্ন দলের এতজন বক্তৃতা দিলেন কিন্তু বিপক্ষ কারও প্রতি ঔদ্ধত্য পূর্ণ কিছু বলেননি। এমনকি ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে আসা আজহারুল ইসলামকেও দেখলাম শালীনভাবে কথা বলতে!!
পুরো মঞ্চটা খেয়াল করলাম। যিনি বক্তব্য দিচ্ছেন, তার আশেপাশে কেউ নেই। বক্তাদের বসার জায়গা ছিলো অনেক পেছনে, আর বক্তৃতা দেবার মাইক ছিলো অনেক সামনে। বক্তার সাথে সেলফি তোলার কোন হিড়িক নেই। হঠাৎ সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন হিন্দু ঐক্যজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক। সোজা-সাপ্টা কথা বলা এই মানুষটা আমার অনেক প্রিয়। আজ বুঝলাম তিনি অনেকের কাছে প্রিয়। গোবিন্দবাবু কথা বলছেন আর লাখ লাখ মুসলমান তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন!! এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
সবশেষে বক্তব্য দিতে আসলেন আমীরে জামায়াত ডাঃ শফিকুর রহমান। তিনি পড়ে গেলেন। ধরাধরি করে আবার উঠলেন। পারলেন না। তারপর বসে বসে বক্তৃতা শুরু করলেন। আমি জানি এই বক্তব্য সোস্যাল মিডিয়ায় অগণিতবার দেখানো হবে। কিন্তু সামনে থেকে এই বক্তব্য পুরো গায়ে কাঁটা দেয়ার মত। বসা অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যখন নেতাকর্মীরা টানা-হ্যাঁচড়া শুরু করলো তিনি সবাইকে মঞ্চেই তার পাশে বসতে বললেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সবাই বসে গেলো!! এমনকি তার প্রেসার মাপতে থাকা ডাক্তারটাও।
রাজনীতির ধরণ পাল্টাচ্ছে- এটাই আমার বড় স্বান্তনা। সাথে দেখলাম প্রায় ৭০ বছর বয়সী নেতার ঈমানী শক্তি। আল্লাহু আকবার। ফেরার পথে দেখলাম লাখ লাখ লোক আবার নিরবে যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছেন। কোন বিশৃঙ্খলা নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই যেন নিয়মের বাঁধনে আটক হয়ে যেভাবে এসেছেন আবার ঠিক একই ভাবে ফিরে গেলেন।
কেন যেন মনে হচ্ছে বিপ্লব আরেকটা হবে। তবে সেটা নিরবে; দাঁড়িপাল্লার।
Naziur Rahman
মেরিন প্রকৌশলী (45/E)
Dhaka, Bangladesh