প্রচ্ছদ অপরাধ ও বিচার আয়নাঘর রহস্য, ৯ বছর পর দুঃসহ স্মৃতির বয়ান আইনজীবীর

আয়নাঘর রহস্য, ৯ বছর পর দুঃসহ স্মৃতির বয়ান আইনজীবীর

অপরাধ: ছয় মাস বন্দি ছিলেন ‘আয়নাঘর’ নামক নির্জন স্থানে। দীর্ঘ সময় ধরে সেই ঘরে থাকাবস্থায় প্রতি মুহূর্তে গুনছেন মৃত্যুর ক্ষণ। ভয় ছিল কখন হত্যা করা হবে। নানা অনুনয় বিনয়ের পর এক দিন চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে রাখা হয় জঙ্গলে। সেখান থেকে ফিরে আসেন পরিবারের কাছে। ফিরে আসার মুহূর্তেও মনে ভয় ছিল, পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা না হয়। আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলেছেন ৯ বছর। কিন্তু নির্দেশ ছিল এ ঘটনা যেন কখনো প্রকাশ করা না হয়। সেজন্য ২০১৫ সাল থেকে মনের ভেতর জমে ছিল আয়নাঘরে বিনা অপরাধে বন্দি থাকার দুঃসহ স্মৃতি।

গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ ৯ বছর পর রবিবার সেই বন্দি জীবনের নির্মম ও নিষ্ঠুর কাহিনী ইত্তেফাকের সামনে তুলে ধরলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সোহেল রানা। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তিনি সেই স্মৃতি যখনই বলছেন, তখন চোখের কোণে জমে ছিল জল। সেটা লুকিয়ে প্রকাশ করেছেন আয়নাঘরের বন্দি জীবনের কাহিনী। তিনি বলেন, একসময় আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম, ফিরতে কি পারব পরিবারের কাছে। দেখতে পারব কি প্রিয় সন্তানের মুখ। তবে আল্লাহতায়লা আমার প্রার্থনা কবুল করেছেন। ফিরেছি পরিবারের কাছে।

আইনজীবী সোহেল রানা বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় ২০১৫ সালে বিএনপির রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলাম। ঐ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোড থেকে আমাকে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তুলে নেয়। গাড়িতে তুলেই চোখ বেঁধে ফেলা হয়। বাজতে থাকে উচ্চস্বরে ডিজে মিউজিক। নির্জন স্থানে নিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ায় আমার মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে এলে চোখ বাঁধা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা অনুভব করি। বুঝতে পারছিলাম একটা বড় জায়গায় ছোট ছোট কুঠুরিতে অনেককেই আটকে রাখা হয়েছে। তখন অনেকেরেই আর্তনাদ শুনতে পাই। মশার কামড়ে ছিল জীবন অতিষ্ঠ। অনেক সময় টেনেহিঁচড়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেত। এরকম আচরণ মানুষের সঙ্গে করতে পারে এটা কল্পনায়ও ছিল না।

তিনি বলেন, আমাদের খাবার ছিল সামান্য পরিমাণে। এক টুকরো মাছ বা মাংস, সামান্য ভাত। আমাদের যারা পাহারা দিত তাদের মধ্যে এক জন খুব নিষ্ঠুর ছিল। অন্যজন অপেক্ষাকৃত একটু কম। তাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে জানতে চাই কোথায় আছি—সে বলে এটা ‘র‍্যাবের কোয়ার্টার’। ৪৮ দিন পড়ে প্রথম গোসলের সুযোগ দেওয়া হয়। একসময় বলা হলো আজই তোমার শেষ দিন। নামাজ পড়ে তওবা কর। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। যারা কান্না করছিল তাদের মারধর করা হয়। আমি নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে অনেক কান্নাকাটি করি। একসময় ওরা জানতে চায়, আমার কয় সন্তান? আমি জানাই ৩ ও ৭ বছরের দুটি সন্তান আছে। আমি বলি, ‘তোমরা আমাকে প্রাণে মেরো না। তখন একজন আমাকে বলে তুই বিএনপি করিস? তারপর বলে আওয়ামী লীগ করতে পারিস না। তারপর আমাকে আয়নাঘরে রেখে বাকিদের নিয়ে যায়।

সোহেল রানা বলেন, ২০১৫ সালের ৬ জুন রাজশাহী র‍্যাব হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৩ আগস্ট মধ্যরাতে আমাকে গাড়ি করে একটি জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। তারা আমকে শর্ত দেয় রাজনীতি ও আইন পেশায় যেন আর না ফিরি। আমি তাদের বলি কোনো দিন রাজনীতি করব না। যাব না কোর্টে। তিনি বলেন, আয়নাঘরে বন্দি থাকাবস্থায় ২৯ মে আমার বাবা মারা যান। আমি তার মুখটি শেষ বারের মতো দেখতে পাইনি। এই কষ্ট কখনো যাবে না। তিনি বলেন, গুমের বিচারের জন্য কোনো আইন নেই। গুমের শিকার মানুষ যেন বিচার চাইতে পারে সেজন্য আমি কাজ শুরু করেছি।

সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।