
জাতীয়: আজ সৌদি আরবসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে ঈদুল ফিতর উদ্যাপিত হচ্ছে। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু অঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশে আজ রোজা পালিত হচ্ছে। কারণ, গতকাল জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি জানিয়েছে দেশের কোথাও শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যায়নি। ফলে আগামী বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে উদ্যাপিত হবে ঈদুল ফিতর।
এদিকে বাংলাদেশে ঈদ উদ্যাপিত না হলেও স্বল্প দূরত্বের রাষ্ট্র পাকিস্তানে ঈদ উদ্যাপিত হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশের পশ্চিমে পাকিস্তান বা সৌদি আরব নয়, বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায়ও আজ ঈদ উদ্যাপন হচ্ছে। তাই কৌতূহল জাগাটাই স্বাভাবিক, এই দেশগুলোর মাঝে অবস্থিত বাংলাদেশে কেন চাঁদ দেখা যায়নি?
এটা এখন প্রতিষ্ঠিত যে, সৌদি আরবে যেদিন ঈদ হয়, বাংলাদেশ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তার পরদিন ঈদ (পাকিস্তান যদিও এবার ব্যতিক্রম)। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্য মাত্র ৩ ঘণ্টা সত্ত্বেও কেন এমন হয়—এ নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে।
এর পেছনের ব্যাখ্যা হলো, সৌদি আরব বাংলাদেশের চেয়ে ৩ ঘণ্টা পিছিয়ে আছে সূর্যের হিসাবে; অর্থাৎ, পূর্ব থেকে পশ্চিমের হিসেবে। কিন্তু ইসলামিক বছরের হিসাব হয় চাঁদের হিসাবে। সৌর-বর্ষে যেখানে পৃথিবীর প্রায় ৩৬৫ দিন সময় লাগে, সেখানে চন্দ্র-বর্ষে দিন সংখ্যা ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন। ফলে প্রতিবছরই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ঈদ ১১/১২ দিন এগিয়ে আসে।
এদিকে পৃথিবী যেমন নিজের অক্ষে ঘুরতে ঘুরতে সূর্যকে ঘিরে ঘোরে, চাঁদও পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের সময় লাগে ২৭ দিন ৭ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ১১.৫ সেকেন্ড। কিন্তু আরবি বছরের ৩৫৪/৩৫৫ দিনের হিসাব বলছে, নতুন চাঁদ দেখা যায় গড়ে প্রায় ২৯.৫ দিন পর। অর্থাৎ, চাঁদ একবার ঘুরে আসার পরও নতুন চাঁদ দেখতে প্রায় দুদিন সময় লেগে যায়। এটা কেন?
কারণ, পৃথিবী থেকে চাঁদ দেখা যাবে কি যাবে না, সেটা কৌণিক দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে। চাঁদের যেহেতু কোনো আলো নেই, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে না আসা পর্যন্ত চাঁদকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এবং চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা পাহাড়ের কারণে যতক্ষণ না চাঁদ ও সূর্যের মধ্যে অন্তত ৭ ডিগ্রি কোণ তৈরি হয়, ততক্ষণ কোনো আলো পৃথিবীতে আসে না। এবং ঈদের চাঁদ বলতে আমরা যে বাঁকা চাঁদকে দেখে অভ্যস্ত, সেটা দেখতে হলে চাঁদ ও সূর্যের মধ্যকার কোণ ১০ থেকে ১২ ডিগ্রির মধ্যে থাকতে হয়।
এদিকে সূর্যকে পূর্ব দিকে আগে দেখা গেলেও চাঁদের হিসাবটা উল্টো। পৃথিবী থেক চাঁদকে পশ্চিম আকাশে দেখা যায়। এবং এ কারণে যত পশ্চিমে থাকবে কোনো দেশ তারাই চাঁদ আগে দেখবে। আবার সৌদি আরব বাংলাদেশের চেয়ে ৩ ঘণ্টা পিছিয়ে আছে সূর্যের হিসাবে। কিন্তু যদি চাঁদের দিক থেকে দেখা হয়, তাহলে আসলে বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরবই এগিয়ে এবং সে ব্যবধান (২৪-৩) বা ২১ ঘণ্টার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একদিন আগে সৌদি আরবে চাঁদ দেখাটাই যৌক্তিক।
তবে ব্যাপারটা এত সরলও না।
সৌদি আরব না হয় পশ্চিমে বলে আগে চাঁদ দেখা যায়, কিন্তু মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া কীভাবে বাংলাদেশের একদিন আগে ঈদ করছে? ওরা তো বাংলাদেশের পূর্ব দিকে! এর কারণ, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের কারণে সব স্থান থেকে একই সময়ে চাঁদ দেখা যায় না। আগেই বলা হয়েছে, খালি চোখে চাঁদ দেখতে হলে চাঁদ ও সূর্যের মধ্যবর্তী কোণ অন্তত ১০ ডিগ্রির বেশি হতে হয়। পূর্বের দেশগুলো যখন চাঁদ দেখে, তখনো বাংলাদেশে দিনের আলো থাকে। ফলে খালি চোখে চাঁদ দেখা সম্ভব না বাংলাদেশে। আর নতুন চাঁদ দেখার সময়সীমাটাও খুব স্বল্প হয়, ১০ মিনিটের মতো। এই সময় আকাশ যদি মেঘলা থাকে, তাহলেও চাঁদ দেখা সম্ভব না।
আবার সৌদি আরবে অনেকদিন ধরেই ঈদ ঘোষণার জন্য শুধু চাঁদের ওপর নির্ভর করা হয় না। ক্যালেন্ডার হিসাব করেও ঈদের ঘোষণা দিতে দেখা গেছে অতীতে। এ কারণে সৌদি আরবের চেয়ে পশ্চিমে থাকার পরও আমেরিকা বা ইউরোপের মুসলিমরা চাঁদ না দেখার কারণে সেদিন ঈদ করেননি, এমন ঘটনাও দেখা গেছে।
বর্তমানে অনেক দেশ চাঁদ দেখার পাশাপাশি জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান ব্যবহার করে ও চাঁদের অবস্থান জেনে ঈদ পালন করেন। অস্ট্রেলিয়াতে যেমন চাঁদ দেখা ও জ্যোতির্বিদ্যা অনুসরণ করে দুটি ভিন্ন দিনে ঈদ পালন হচ্ছে এবার।
জ্যোতির্বিদ্যা থেকে যদি উত্তর খুঁজতে চাওয়া হয়, তাহলেও কিন্তু কেন বাংলাদেশে চাঁদ দেখা যায়নি, তার একটা ব্যাখ্যা মেলে। মুন সাইটিং ডট কমে চাঁদের বর্তমান অবস্থান ও বিশ্বের কোন স্থান থেকে চাঁদ দেখা যাবে, তা দেখা যায়। ইসলামি রীতিতে কোথায় কোথায় চাঁদ দেখা যাবে, তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয় সেখানে।
এই সাইটের তথ্য অনুযায়ী, নতুন চাঁদ গত ৮ এপ্রিল গ্রিনিচ সময় সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিট ৩২ সেকেন্ডেই দেখা দিয়েছে। কিন্তু কৌণিক দূরত্বের কারণে সেদিন বিশ্বের কোনো স্থান থেকেই খালি চোখে তা দেখা সম্ভব হয়নি।
৯ এপ্রিলের হিসেব আবার ভিন্ন। গতকাল দুই আমেরিকা মহাদেশ, ইউরোপ ও আফ্রিকার বেশ বড় একটা অঞ্চল থেকে খালি চোখে বেশ সহজেই চাঁদ দেখা গেছে। এশিয়ার সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়া ও ইরান-ও এই সবুজ (খালি চোখে সহজে দেখার) অঞ্চলে ছিল। এরপরই, অর্থাৎ ইরানের পূর্বাঞ্চল থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া পর্যন্ত অঞ্চলেও চাঁদ খালি চোখে দেখার সুযোগ ছিল। তবে এই নীল অঞ্চলে (আদর্শ কন্ডিশনে খালি চোখে দেখা যাবে) আবহাওয়া ও বাকি সবকিছু একদম নিখুঁত হতে হতো। অর্থাৎ আকাশ মেঘলা থাকলে চলবে না। গতকাল নীল অঞ্চলে থাকলেও বাংলাদেশের আকাশে যে স্বল্প সময় চাঁদ দেখা যায়, ওই সময়ে সবকিছু হয়তো নিখুঁত ছিল না।
ইন্দোনেশিয়ার (ধুসর অঞ্চল) ক্ষেত্রে টেলিস্কোপের সহযোগিতা নিতে হয়েছে গতকাল। এবং অস্ট্রেলিয়ার (লাল অঞ্চল) ক্ষেত্রে চাঁদ দেখতে টেলিস্কোপ ছাড়া চাঁদ দেখার কোনো সুযোগই ছিল না।
আর আজ অর্থাৎ, ১০ এপ্রিলে বিশ্বের জনবসতি আছে, এমন প্রায় সব অঞ্চল থেকেই চাঁদ দেখা যাবে। অর্থাৎ, আজ হয়নি এমন সব স্থানে আগামীকাল ঈদ উদযাপিত হবে।