প্রচ্ছদ জাতীয় শতকোটি টাকা মালিক হয়ে চাকরি ছাড়লেন এনবিআরের পিয়ন

শতকোটি টাকা মালিক হয়ে চাকরি ছাড়লেন এনবিআরের পিয়ন

এক সময়ে ভিটেবাড়ি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ ছিল না তার। সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের দিনমজুর মৃত শেখ তমেজ উদ্দীনের ৩ ছেলে, ২ মেয়ের মধ্যে মাহমুদুল ইসলাম সবার ছোট। বাবার সঙ্গে একসময় দিনমজুরির কাজ করতেন। ’৯০-এর দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে অফিস সহায়ক (পিয়ন) পদে চাকরিতে যোগ দেন মাহমুদুল ইসলাম।

প্রথমে তিনি এনবিআর প্রধান কার্যালয়ে ছিলেন। এরপর খুলনা, কুষ্টিয়া হয়ে বদলি হন নিজ জেলা সাতক্ষীরায়। দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় তিনি কর্মরত ছিলেন সাতক্ষীরা শহরের উপকর কমিশনারের (সার্কেল-১৩) কার্যালয়ে (ইনকাম ট্যাক্স অফিস)। সেখানে একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারের সঙ্গে সখ্য গড়ে অবৈধ পথে বিপুল অর্থ আয় করেন। তার সম্পদের অলৌকিক সব কারবার নিয়ে এলাকায় সমালোচনা শুরু হলে চাকরি ২৫ বছর হওয়ামাত্রই তিনি ২০১৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন।

অষ্টম শ্রেণি পাশ মাহমুদুল সাতক্ষীরায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অফিস সহকারী (পিয়ন) পদে চাকরিতে যোগ দিয়েই যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পেয়েছিলেন। এখন সাতক্ষীরার সবচেয়ে বড় শপিং কমপ্লেক্স, চার তলা বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিশাল মাছের ঘেরসহ নামে-বেনামে শতকোটি টাকার সম্পদ গড়ে এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর এসব সম্পদের উৎস নিয়ে যখন কানাঘুষা শুরু করেন স্থানীয়রা, তখনই নিজেকে রক্ষায় স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে বিচলিত মাহমুদুল তার অন্তত ৩০ কোটি টাকার একটি শপিং কমপ্লেক্স বেচে দেয়ার পাঁয়তারা করছেন। তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে দুদকে তিন দফা অভিযোগ জমা পড়লেও অদ্যাবধি নেয়া হয়নি কোনো ধরনের ব্যবস্থা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাতক্ষীরার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র পাটকেলঘাটার পল্লী বিদ্যুৎ রোডসংলগ্ন এলাকায় নজরকাড়া বহুতল শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছেন মাহমুদুল। ‘বাঁধন শপিং কমপ্লেক্স’ নামের এই ভবনে রয়েছে তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ১২ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত অত্যাধুনিক শপিংমলটি ২০২১ সালে উদ্বোধন করা হয়। জমি ও মালামালসহ এ খাতে তার বিনিয়োগ অন্তত ৩০ কোটি টাকা।

পাটকেলঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ৪৭ দাগের ৯ শতাংশ জমিতে তৈরি করেছেন আলিশান চার তলা বাড়ি। বাড়ির পাশ ঘিরে তৈরি করা হয়েছে পাকা পুকুর। ১৭ শতাংশ জায়গায় ওই পাকা পুকুরকে এলাকার লোকজন সুইমিংপুল হিসাবে জানেন। জায়গা কিনে এই বাড়ি করতে তার অন্তত ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। স্ত্রী নাছিমা বেগমের নামে পাটকেলঘাটা বাজারের সবচেয়ে দামি রাজেন্দ্রপুর মৌজার ১৪৯ দাগে ১৭ শতাংশ, ১৫০ দাগে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৪৭ দাগে ৯ শতাংশ ও পাটকেলঘাটা চৌরাস্তা মোড়ে ৮১ দাগে ১ শতাংশ জমি কিনেছেন।

আরো জানা গেছে, কন্যা ঊর্মির নামে পাটকেলঘাটার পাঁচ রাস্তা মোড় এলাকায় গড়ে তুলেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘ঊর্মি এন্টারপ্রাইজ’। রয়েছে মালামাল পরিবহণের বেশ কয়েকটি ট্রাক ও ইটভাটা। অভিযোগ আছে, এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তিনি চোরাকারবারে জড়িত। এছাড়া ঊর্মির নামে বালিয়াদোহা গ্রামে রয়েছে কয়েক বিঘা জমি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার যেসব সম্পদ আছে সেগুলো আয়কর ফাইলে দেখানো আছে। শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য ঠিক নয়, আমার ৪০ লাখ টাকার মতো সম্পদ আছে।’ বাড়ি, শপিং কমপ্লেক্স, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে এত সম্পদের দাম কীভাবে মাত্র ৪০ লাখ টাকা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক সম্পদ আমি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে করেছি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এখনো আমার ঋণের পরিমাণ অন্তত পাঁচ কোটি টাকা।’ ৪০ লাখ টাকার সম্পদ বন্ধক দিয়ে আপনি কীভাবে ৫ কোটি টাকা ঋণ নিলেন-এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

দুর্নীতি ঢাকতেই কি আপনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর নামে আগেই কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। আর দুর্নীতি ঢাকতে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। চাকরি জীবনে আমি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রধান কার্যালয়, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছি। সাতক্ষীরা থাকাকালে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ততার কারণে আমি চাকরি থেকে অবসর নিই।’