
অপরাধ: ধারের টাকা শোধ করতে না পারায় গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া মামলার প্রধান আসামি জয়নাল মিয়া। গত রোববার (২ জুন) আদালতে তোলা হলে মূল আসামি জয়নাল জবানবন্দি দেন। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে কমিটি গঠন করে ঘটনা তদন্ত এবং দ্রুত তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দিতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
জানা যায়, রাজিবপুর উপজেলা সদরের কলেজপাড়া এলাকার জাহাঙ্গীর আলম তৃতীয় বিয়ে করেন খালাতো বোন আশা খাতুনকে। আশার বাবা ছিলেন ঘর জামাই। আশার মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে ঢাকায় গিয়ে আরও একটি বিয়ে করেন তিনি। আশার মা চলে যান দেশের বাইরে। এতিমের মতো জাহাঙ্গীরদের বাড়িতে থাকতো আশা। দুই স্ত্রী থাকা অবস্থায় জাহাঙ্গীর আশাকে বিয়ে করলে দ্বিতীয় স্ত্রী বাবার বাড়ি চলে যায়। প্রথম স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে পাশে নতুন বাড়ি করে আশাকে নিয়ে থাকতেন জাহাঙ্গীর। বাজারে কসাইয়ের দোকানে কাজ করলেও দেনা-পাওনা হওয়ায় টাঙ্গাইলে যান কাজের সন্ধানে।
এদিকে ঘটনার মূল আসামি অভিযুক্ত জয়নাল পেশায় কসাই। তার সঙ্গেও কাজ করেছে জাহাঙ্গীর। ফলে প্রয়োজনে তার কাছে টাকা ধার নিতো। প্রায় ৭০ হাজার টাকা নিয়ে পরিশোধও করে জাহাঙ্গীর। বাড়িতে গেলে কথা হয় জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তার ভাষ্যমতে, তার কাছে কোন টাকা পেত না জয়নাল। তবে তার শাশুড়ি ও স্ত্রী মিলে জয়নালের কাছে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ২০ টাকা হাজার টাকা পরিশোধ করে। বাকি টাকা পাওনা ছিল। ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার সময় বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। যদিও এলাকার অনেকে বলেছেন, স্বামী-স্ত্রী মিলে জয়নালের কাছ থেকে টাকা নেন তারা। এ নিয়ে পারিবারিক সালিশও হয়েছে। যদিও এ ঘটনা নিয়ে এলাকার লোকজন কথা বলতে রাজী নন।
জাহাঙ্গীর বলেন, আমি টাঙ্গাইল থেকে আইসা দেখি পরিবারের অবস্থা ভাল না। পরে জিজ্ঞেস করলে আমারে ঘটনা বলে। ওরা খুব নির্যাতন করেছে। পাওনা টাকার ব্যাপারে বলেন, আমার কাছে এক টেহাও পায় না জয়নাল। প্রায় ৭০ হাজার টেহা নিছি। সব দিয়ে দিছি। ওরা (শাশুড়ি-স্ত্রী) যে টেহা নিছে হেইটা তো পরে জানলাম। টাঙ্গাইল থেকে বাড়িতে আসলে ধর্ষণের ঘটনা স্বামীকে বলেন আশা। এ সময় আশার মামা আকবর আলী উপস্থিত ছিলেন। মুঠোফোনে আশার কথাগুলো অডিও রেকর্ড করা হয়। প্রায় ২০ মিনিটের অডিওতে গৃহবধূ একাধিকবার বলেছেন, টাকার জন্য খুব চাপ দিতো জয়নাল। টাকা না দিতে পারলে অন্য কিছু (কুপ্রস্তাব) দিতে বলে জয়নাল। টানা টাকার চাপ দেয়ায় কুপ্রস্তাবে এক সময় রাজি হয় আশা। প্রথম দিকে জয়নাল একাই জাহাঙ্গীরের ঘরে আশার সঙ্গে মিলিত হতো। যখনই মন চাইত তখনই জয়নাল আশার কাছে আসতো। একদিন আর এক কসাই শুক্কুর আলীকে সঙ্গে নিয়ে আসে জয়নাল। এরপরে সোলায়মান ও আলমকে নিয়ে আসে। তাদের সঙ্গেও মেলামেশায় বাধ্য করে জয়নাল। সোলায়মান ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিয়েও গৃহবধূকে ধর্ষণ করে। জয়নাল ও শুক্কুর দুজন মিলে তার ওপর একসাথে নির্যাতন চালায়।
অডিওতে গৃহবধূকে বলতে শোনা যায়, প্রথমে টেহা নিতে আসছে জয়নাল ভাই। খুব চাপ দিছে। আইয়া আমারে কয় এ খাড়ার মধ্যে টেহা দাও। এরম কইরা ব্ল্যাকমেইল কইরা আমার সঙ্গে থাকছে। হ্যায় কইছে তোমার যদি টেহা লাগে আমার কাছে থেকে নিও। সে বড় ভাই এজন্য টেহা নিছি। আমারে মাইরে তারা শ্যাষ করছে। নির্যাতনের বিষয়ে স্বামীকে বলতে শোনা গেছে। স্ত্রী ও জয়নালের বিষয়ে আগে থেকে সন্দেহ ছিল জাহাঙ্গীরের। তখন আশাকে জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার যায়। সে বিষয়টিও শোনা গেছে অডিওতে।
স্ত্রীর কথা শোনার পর রাজীবপুর থানায় অভিযোগ করতে যায় জাহাঙ্গীর। কিন্তু থানার সামনে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেনসহ একাধিক লোকজন তাদের থানায় যেতে দেয়নি। এ সময় থানার রবিউল নামে এক কনস্টেবল ছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরেরও পরিচিত। ওই কনস্টেবল বাড়িতে বিচারের আশ্বাস দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেন। বাড়িতে এসে জয়নালরা হাত ধরে ভুল স্বীকার করে মাফ চেয়ে চলে যান। পরে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয় জাহাঙ্গীরের।
গত ২৪মে দুপুরে বাড়িতে আত্মহত্যা করতে স্বামী-স্ত্রী মিলে কীটনাশক খায়। তাদের উদ্ধার করে রাজীবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসায় জাহাঙ্গীর সুস্থ হলেও আশাকে রেফার্ড করা হয় জামালপুর সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে তিনদিন থাকার পর অবস্থার অবনতি হলে আশাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন চিকিৎসক। কিন্তু আশাকে নিয়ে আসায় হয় বাড়িতে। ২৯ মে দুপুরে বাড়িতে মৃত্যু হয় আশার। দ্রুত দাফনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করতে মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ দাফন করা হয়।
মূলত ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একটি চক্র উঠে পড়ে লাগে। ময়নাতদন্ত ছাড়া মরদেহ দাফনের কথা বলে সাদা স্ট্যাম্পে জাহাঙ্গীরের স্বাক্ষর নেন ইউপি মেম্বার আনোয়ার। জাহাঙ্গীরের ভাইয়ের কাছে টাকা নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর বলেন, আনোয়ার মামায় (মেম্বার) আইসা কইলো। পোস্টমর্ডেম ছাড়া মাটি দিতে গেলে তোর সই করণ লাগবো। আমি বললাম সই কেনে। আমার তো হুশ নাই। কিছু লেহা ছিল না। সাদা স্ট্যাম্পে সই দিছি।
এ বিষয়ে ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, সাদা কাগজে সই নেয়া হইছে। কাগজ ছিঁড়ে ফেলা হইছে। জাহাঙ্গীরদের থানায় যেতে না দেয়ার ঘটনায় নাম ওঠা কনস্টেবল রবিউলকে পাওয়া যায়নি। কর্মকর্তারা বলছে, তদন্তে যে দোষী হবে কারও ছাড় হবে না। ৩১ মে (শুক্রবার) মধ্যরাতে ধর্ষণ ও আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে জয়নালসহ চারজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন আশার মামা আকবর আলী। শনিবার দুপুরে এজাহারের প্রধান আসামি জয়নাল ও তিন নম্বর আসামি আলমকে জামালপুরের একটি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রোববার কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রাজীবপুর আমলি আদালতে তোলা হলে বিচারক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আবু তালেব মিয়া আসামির জবানবন্দি নথিভুক্ত করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আসামি জয়নাল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে পুলিশ ও আদালত সূত্র জানিয়েছে।
মামলার বাদী আকবর আলী বলেন, আমার ভাগ্নি মারা গেছে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। মামলা করেছি বিচার পাবার আশায়। বিচার চাই। কঠিন বিচার চাই।
রাজীবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিকুর রহমান আশিক বলেন, খবর পাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা গিয়ে দেখতে পায় মরদেহ দাফনের প্রক্রিয়া চলছে। পরে মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে অভিযোগ না পাওয়ায় ইউডি মামলা নেয়া হয়। পরবর্তীতে গৃহবধূর মামা মামলা করেছেন, দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এ ঘটনা তদন্ত করতে রোববার কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত আদেশে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসককে বলা হয় তদন্ত কমিটি করে ঘটনার পূর্ণ বৃত্তান্ত কমিশন বরাবর পাঠাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত কাজ জরুরি করে আদালতে প্রতিবেদন এবং কমিশনকে অবহিত করতে বলা হয় পুলিশ সুপারকে। আগামী ১৬ জুলাই এসব প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, আমরা চিঠি পেয়েছি। দ্রুত কমিটি করে তদন্ত করা হয়। পুলিশ সুপার আল আসাদ মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চিঠি আমরা পেয়েছি। ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে এ ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে সোমবার দুপুরে কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কুড়িগ্রাম শাখা। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধনে পরিষদের সভাপতি রওশন আরা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক প্রতিমা চৌধুরীসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |