
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে ভারতের উপর চাপ বাড়ছেই। এখন ঢাকার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার মতো খুব কম যুক্তিই রয়েছে নয়াদিল্লির কাছে।
গত গ্রীষ্মে শেখ হাসিনা সরকারি কোটা ব্যবস্থার সংস্কার এবং পুনর্গঠনের দাবিতে বিক্ষোভকারী অন্তত ১ হাজার বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যায় রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রীকে শীঘ্রই ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং গেল আগস্টে তিনি ভারতে পালিয়ে যান।
হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫ বছরের শাসনামলে হত্যা সহ একাধিক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। গত মাসে হাজার হাজার মানুষ তার বিচারের জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ করায় বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে একটি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ (চিঠি) পাঠায়।।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পাসপোর্ট বাতিল করে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা আরো জোরদার করেছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি।
এছাড়াও হাসিনার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের বিডিআর বা বাংলাদেশ রাইফেলস বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হচ্ছে। নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে তিনি বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদারকি করেছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়।
হাসিনার শাসনামলে ২০০৯ সালের পিলখানা গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস করা হয়। একারণে হত্যাকাণ্ডটি পুনঃতদন্তের জন্য বাংলাদেশে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন (এনআইসি) গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিশনের চলমান তদন্তে হাসিনার জড়িত থাকার ইঙ্গিত করা হয়েছে।
প্রমাণ সংগ্রহ এখনও চলমান রয়েছে। তবুও এনআইসি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় হাসিনার ভূমিকা ছিল বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। এই ঘটনায় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা।
তদন্ত কমিশন এখন ভারত থেকে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানাচ্ছে। নয়াদিল্লি এতে অস্বীকৃতি জানালে তা হবে একটি কৌশলগত ভুল হবে। এতে অভিযোগের তীব্রতা বা বাংলাদেশি জনগণের বিরুদ্ধে হাসিনার করা অপরাধের দীর্ঘ তালিকা অস্বীকার করার চাইতেও বেশি কিছু করা হবে।
সামরিক বিদ্রোহ
২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের কারণ উদঘাটনে হাসিনা প্রশাসন গণহত্যার তদন্ত শুরু করে। সেই তদন্তে দাবি করা হয়, বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছিল উন্নত কর্মপরিবেশের অভাব, নিম্ন বেতন স্কেল এবং সেনা সদস্যদের তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আচরণের কারণে।
যদিও আজ পর্যন্ত ২০০৯ সালের গণহত্যার শিকারদের পরিবারগুলি ওই তদন্ত প্রতিবেদনে আশ্বস্ত নয়। বর্তমানে তারা মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য জোর দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন। যার ফলে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন পুনর্তদন্ত শুরু করেছে। কমিশন ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে এক মতবিনিময় বৈঠকের পর হাসিনাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ভারতীয় সিদ্ধান্ত দ্রুত জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। এটি নয়াদিল্লির জন্যও পরিণতি বহন করে।
কূটনৈতিক দ্বিধা
ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে আসছে এবং বছরের পর বছর ধরে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল হাসিনা। ক্ষমতাচ্যুতির পর সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীক নিজেদের কাছে রেখে নতুন হাসিনা-বিরোধী বাংলাদেশ সরকারে প্রভাব পুনরুদ্ধার করা হবে ভারতের সামনে একটি কঠিন কাজ।
বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচ বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনামলে ঢাকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে যোগাযোগ এবং আস্থা তৈরির পদক্ষেপ নেওয়া হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের সাথে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার পর তাকে প্রত্যর্পণে বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ আইনি অনুরোধ ভারতের কূটনৈতিক দ্বিধাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। বিডিআর গণহত্যা, আর্থিক অপরাধ অথবা গুমখুনের ঘটনায় তার দায় যাই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং জনগণ হাসিনাকে তার শাসনামলে সংঘটিত অপরাধের জন্য জবাবদিহীতার কাঠগড়ায় দেখতে চায়।
আজ হোক কাল হোক, নয়াদিল্লিকে মেনে নিতে হবে, বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের সাথে ততদিন সম্পর্কের উন্নতি হবে না, যতদিন পর্যন্ত হাসিনা ভারতে আশ্রয় পাবেন।
এই সম্পর্ক উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তিকে সম্মান করা, যা বাংলাদেশ ২০১৩ সালে স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে পলাতকদের বিনিময় দ্রুত ও সহজ করতে এই চুক্তি সংশোধন করা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশ এমন ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণের জন্য সম্মত হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, অভিযোগ আনা হয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন সব অপরাধ, যার সর্বনিম্ন সাজা এক বছরের কারাদণ্ড। এর মধ্যে আর্থিক অপরাধও অন্তর্ভুক্ত। অপরাধটি প্রত্যর্পণযোগ্য হতে হলে দ্বৈত অপরাধের নীতি প্রযোজ্য হতে হবে, অর্থাৎ অপরাধটি উভয় দেশে শাস্তিযোগ্য হতে হবে। এসব অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের প্রত্যর্পণ করতে হবে।
হাসিনার ক্ষেত্রে এটি স্পষ্টতই প্রযোজ্য। কারণ তিনি নরহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ২০০৯ সালের বিডিআর মামলার অভিযোগের মুখোমুখি। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে তিনি আধাসামরিক বাহিনীকে বেসামরিক নাগরিক ও সৈন্যদের হত্যা, গণহত্যা এবং পঙ্গু করার সম্মতি দিয়ে দেশের সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন।
এছাড়াও, প্রত্যর্পণ চুক্তির ১০ (৩) অনুচ্ছেদের সংশোধনী অনুযায়ী, প্রমাণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের উপযুক্ত কোনো আদালত কারোর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে হাসিনার মতো ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।
ফলে হাসিনাকে অব্যাহতভাবে আশ্রয় দেওয়া হলে ভারত বাংলাদেশে আর প্রভাব ধরে রাখতে পারবে না। নয়াদিল্লিকে এর মূল্য চোকাতে হবে প্রতিবেশীদের মধ্যে বৈরীতা ক্রমেই বাড়তে থাকা একটি মিত্রকে বিচ্ছিন্ন করে। যে ভারত দোরগোড়ায় একটি দৃঢ় চীন এবং পাকিস্তানের মুখোমুখি।
আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখার কারণে ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালের দমনপীড়নকে হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার করার একটি উপযুক্ত ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
ঢাকা ইতোমধ্যেই হাসিনার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আবেদন করেছে এবং একটি মামলা দায়ের করেছে। যা এখনও আদালতে বিচারাধীন।
কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে দিয়েছেন, ন্যায়বিচারের জন্য বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারে। নয়াদিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ড. অকালব্য আনন্দ টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, ভারত যদি তার দায়িত্ব অস্বীকার করে, তাহলে বাংলাদেশ বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়ে যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে, নিয়মগুলি স্পষ্ট এবং ভারতের সীমিত সুযোগ থাকবে। পূর্ববর্তী আইসিজে মামলায় যেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাকে হয় মেনে চলতে হবে অথবা বিচার পরিচালনা করতে হবে।
ফলে নয়াদিল্লির পক্ষে হাসিনাকে ভারতে রেখে দেওয়ার রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপাক্ষিক খরচ হবে অনেক বেশি।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এখন তার নিজ দেশে অপরাধ ও গণহত্যার আরেকটি মামলায় অভিযুক্ত। তাই ভারতের জন্য সর্বোত্তম পদক্ষেপ হল তাকে হস্তান্তর করা।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |