
মাত্র ১০ মাসের মাথায় বদলি হয়ে গেলেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিস্তা করিম। ২০২৪ সালের ২ জুন যোগ দিয়েছিলেন তিনি, আর গত ২৯ এপ্রিলেই তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার আদেশ এলো। কিন্তু কেন? এই বদলির পেছনে কী প্রশাসনিক রুটিন, নাকি রয়েছে কোনো সুপরিকল্পিত চাপ? স্থানীয় জনমত বলছে, ফারিস্তা করিমের নেতৃত্বে পরিচালিত মাটি খেকো, বালু দস্যু ও অবৈধ ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযানই তাঁর বদলির আসল কারণ।
ফারিস্তা করিম সাতকানিয়ায় এসেই স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগী হন। ভূমি অফিসে সেবা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, দালালের দৌরাত্ম্য, দুর্নীতিগ্রস্ত পদ্ধতি—সবকিছুতেই তিনি শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করেন। ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের হার বাড়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালান, “ভূমি সেবা সপ্তাহ” আয়োজন করেন নিয়মিত। ডিজিটাল খতিয়ান ও নামজারি ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে সচেষ্ট হন। তবে তাঁর প্রশাসনিক পরিচিতি তৈরি হয় মূলত ভূমি রক্ষায় পরিচালিত একের পর এক অভিযানের মাধ্যমে।
সাতকানিয়ার সাঙ্গু নদী, ডলু খাল ও বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে অবৈধভাবে মাটি ও বালু উত্তোলন। এতে নদী-খাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, এমনকি ভূমিধসের আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। অথচ প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় এই অবৈধ ব্যবসা চলে আসছিল বছরের পর বছর। এসব দুর্বৃত্ত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এসিল্যান্ড ফারিস্তা করিম। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই এসব বিষয়ে অভিযান শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত ১০ মাসে তিনি যেসব মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন এর বেশিরভাগই ছিল অবৈধ মাটি-বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে।
সাতকানিয়ায় ৭২টির মতো ইটভাটা রয়েছে, যার বেশিরভাগই অনুমোদনবিহীন কিংবা পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে পরিচালিত হচ্ছিল। বিশেষ করে কৃষি জমির টপসয়েল কেটে মাটি সংগ্রহ, লাইসেন্স নবায়ন না করা—এসব কারণে পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছিল। এসিল্যান্ড ফারিস্তা করিম অবৈধ ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করেন।
এসব অভিযান সাধারণ মানুষের কাছে তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। বিশেষ করে কৃষক সমাজ, যারা ভূমির ওপর নির্ভরশীল, তারা এই অভিযানকে স্বাগত জানায়। অন্যদিকে এসব অভিযান স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে তাঁর বদলির আদেশ আসে। তাঁকে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা সার্কেলের এসিল্যান্ড হিসেবে পদায়ন করা হয়। যদিও সরকারিভাবে বলা হচ্ছে এটি রুটিন বদলি, তবে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলে এটি নিয়ে কানাঘুষা চলছে। অনেকেই বলছেন, প্রভাবশালী মহলের চাপে তাঁকে সরানো হয়েছে।
ফারিস্তা করিম একজন নারী কর্মকর্তা হিসেবে পুরুষশাসিত একটি রাজনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালন করে যে সাহসিকতার পরিচয়, তা বিরল নিয়মিত ফিল্ডে যাওয়া, অভিযান পরিচালনা সবকিছুতেই তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ফারিস্তা করিমের বদলির পর সাতকানিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ বলেন, ‘সৎ অফিসারদের জায়গা হয় না’, কেউ লেখেন, ‘যারা দুর্নীতি করে, তারা বহাল থাকে; যারা কাজ করে, তারা সরানো হয়।’