প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ: কী ঘটছে, কেন ঘটছে?

সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ: কী ঘটছে, কেন ঘটছে?

থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার বিতর্কিত সীমান্তে আবারও প্রাণঘাতী সহিংসতা শুরু হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বহুদিন ধরে চলা, কিন্তু তুলনামূলকভাবে অজানা এই বিরোধ আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

বৃহস্পতিবার থাই সেনাবাহিনী কাম্বোডিয়ার সামরিক অবস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে। এর আগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো একটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে থাই সেনার পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা উত্তেজনার বিস্ফোরণ ঘটায়।

উভয় পক্ষই একে অপরকে আগ্রাসনের দায়ে অভিযুক্ত করছে, আর এই টানাপোড়েন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সংঘাত এখন পুরোপুরি যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, সংঘর্ষে ১১ জন বেসামরিকসহ মোট ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩১ জন। কাম্বোডিয়া এখনো তাদের পক্ষের হতাহতের সংখ্যা জানায়নি।

সাম্প্রতিক উত্তেজনার পেছনের কারণ কী?

এ বছরের মে মাসে কাম্বোডিয়ার এক সেনা থাই সীমান্তে সংঘর্ষে নিহত হন। সংঘর্ষস্থল ছিল এমারেল্ড ট্রায়াঙ্গেল এলাকায়, যেখানে থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া ও লাওসের সীমান্ত মিলেছে।

উভয় পক্ষই দাবি করেছে, তারা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরেছিল এবং একে অপরকে দোষারোপ করেছে।

যদিও দুই দেশের সামরিক নেতারা উত্তেজনা প্রশমনের কথা বলেছিলেন, এরপর থেকেই সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ও একে অপরকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা বাড়তে থাকে।

থাইল্যান্ড সীমান্তের চেকপোস্টগুলোর দায়িত্ব নিয়ে সেখানকার যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয়। জবাবে, কাম্বোডিয়া থাই ফলমূল আমদানি বন্ধ করে এবং থাই সিনেমা-নাটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এইসব কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ঘটে যায় দুটি ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ। প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে ১৬ জুলাই, যেখানে এক সেনা পা হারান। দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঘটে বুধবার, যেখানে পাঁচ সেনা আহত হন, এবং একজন পা হারান। বৃহস্পতিবারের সহিংসতা ছিল এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মাত্রার।

এই সীমান্ত নিয়ে বিরোধ কেন?

থাইল্যান্ড ও কাম্বোডিয়ার সম্পর্ক অনেকটা টানাপোড়েনপূর্ণ—কখনও সহযোগিতা, আবার কখনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনামলে আঁকা ৮১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তটি আজও পুরোপুরি নির্ধারিত নয় বলে থাইল্যান্ড দাবি করে। এই সীমান্তজুড়ে বহুবার সামরিক সংঘর্ষ হয়েছে।

কাম্বোডিয়া অতীতে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোর রায় চেয়েছে, যার মধ্যে ছিল সাম্প্রতিক সংঘর্ষস্থলও। তবে থাইল্যান্ড আদালতের এখতিয়ার স্বীকার করেনি।

২০১১ সালে দুই দেশের সেনারা প্রাচীন প্রেহা ভিহেয়ার মন্দির ঘিরে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওই সময় কমপক্ষে ২০ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ উভয় দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে পালাতে বাধ্য হন। এই মন্দির ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

এর প্রভাব কী হয়েছে?

মে মাসের সংঘর্ষ থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। থাই প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন শিনাওয়াত্রাকে জুলাই মাসে দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর কারণ ছিল কাম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে তার একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়া।

সেই ১৭ মিনিটের ফোন কলে তিনি নিজের দেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা থাই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশ্ন তোলে।

থাইল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন (বয়স ৩৮), যিনি এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তার বরখাস্ত হওয়া দেশের রাজনীতিতে নতুন করে অস্থিরতা ডেকে এনেছে।

বর্তমানে কী বলছে উভয় দেশ?

বৃহস্পতিবার সকালে সংঘর্ষ শুরু হয়। থাইল্যান্ড অভিযোগ করে, কাম্বোডিয়া তাদের ভূখণ্ডে রকেট ছুড়েছে। এর জবাবে থাই যুদ্ধবিমান কাম্বোডিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে বোমা নিক্ষেপ করেছে।

কাম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থাইল্যান্ডের কর্মকাণ্ডকে ‘নৃশংস ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করেছে। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, থাইল্যান্ডের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান প্রেহা ভিহেয়ার মন্দিরের কাছে একটি সড়কে দুটি বোমা ফেলে।

তারা বলেছে, ‘কাম্বোডিয়া আত্মরক্ষার অধিকার সংরক্ষণ করে এবং যেকোনো মূল্যে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত।’

এদিকে, থাইল্যান্ডের দ্বিতীয় আঞ্চলিক সামরিক কমান্ড জানিয়েছে, তারা দুটি কাম্বোডিয়ান সামরিক ইউনিট ধ্বংস করেছে। তারা দাবি করেছে, শুধুমাত্র সামরিক স্থাপনার উপর হামলা চালানো হয়েছে।

থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই বলেছেন, কাম্বোডিয়া লক্ষ্যহীনভাবে ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছে, যা বেসামরিক হতাহতের কারণ হয়েছে। তিনি জানান, সংঘাত এখনো সীমিত রয়েছে এবং অন্যান্য প্রদেশে ছড়ায়নি।

তিনি বলেন, যতক্ষণ না সংঘর্ষ বন্ধ হচ্ছে, ততক্ষণ কোনো ধরনের আলোচনা সম্ভব নয়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কী?

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র টমি পিগট বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এই সহিংসতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা অবিলম্বে সংঘর্ষ বন্ধ, বেসামরিক জনগণের সুরক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’

বৃহস্পতিবারই যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদেরকে থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, যদি না খুব জরুরি প্রয়োজন পড়ে।

দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দশকব্যাপী সীমান্ত বিরোধ ফের রক্তাক্ত রূপ নিচ্ছে। কূটনৈতিক উত্তেজনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা মিলিয়ে সংঘাত বড় আকার ধারণ করতে পারে—যা শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।

এখন প্রশ্ন, দুই দেশ যুদ্ধের পথে এগোবে, নাকি দ্রুত শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে ফিরবে?