প্রচ্ছদ সারাদেশ সালমা-শামীমের ‘আলাদিনের চেরাগে’ সিআইডির বাগড়া

সালমা-শামীমের ‘আলাদিনের চেরাগে’ সিআইডির বাগড়া

দেশজুড়ে: ত্রিশ বছর বয়সী শামীম ভূঁইয়ার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের বুধন্তী গ্রামে। বাবা কৃষক, অভাব-অনটনের সংসারের হাল ধরতে ২০১৩ সালে ঢাকা আসেন তিনি। বিয়ে করেন নিজের থেকে ২৫ বছরের বড় সালমা ভূঁইয়াকে। এরপর এই দম্পতি হাতে পান ‘আলাদিনের চেরাগ’! ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ‘কেনেন’ একের পর এক বাড়ি ও ফ্ল্যাট; চড়েন দামি গাড়িতে। গ্রামেও এখন তার আলিশান বাড়ি। দুটি প্রতিষ্ঠান খুলে বিনিয়োগের জন্র কাছ থেকে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এক যুগ সময়ের মধ্যে এই দম্পতি এখন শতকোটি টাকার মালিক!

কিন্তু সালমা-শামীম দম্পতির এই আলাদিনের চেরাগে বাগড়া দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সংস্থাটির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের কর্মকর্তারা বলছেন, এই দম্পতি এতসব সম্পত্তির মালিক হয়েছেন শুধু প্রতারণা করেই! এবার তাদের সেই প্রতারণার সম্পদের লাগাম টেনে ধরতে উদ্যোগী হয়েছে সিআইডি। এরই মধ্যে মামলা হয়েছে মানি লন্ডারিং আইনে। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে আদালত তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ (ক্রোক) করেছেন। পাশাপাশি ২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হয়েছে।

সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সালমা ও শামীম দম্পতির ঢাকা ও নারাণগঞ্জে থাকা বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমিসহ সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রোক করা সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক বা রিসিভার করা হয়েছে ঢাকা জেলা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে।

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, সালমা ও শামীম দম্পতি প্রতারণা করে শত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হলেও তারা এখন তা আর ভোগ করতে পারবেন না। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রিসিভারের জিম্মায় থাকবে তাদের অবৈধ সম্পত্তি।

সালমা-শামীম দম্পতির যেসব সম্পত্তিতে রিসিভার নিয়োগ: সিআইডি সূত্র জানায়, শামীম ভূঁইয়া বিভিন্ন টেন্ডারের ওয়ার্ক অর্ডার জাল জালিয়াতি করে কাগজপত্র বানিয়ে ‘জেড টেকনোলজি ও ইসমাইল ট্রেডার্স লিমিটেডের কাছ থেকে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রলোভন দেখিয়ে ফখরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দুই কোটি ৯১ লাখ টাকা, জায়েদুল হাসানের কাছ থেকে ৯৪ লাখ,

ওয়াহিদুজ্জামান সানির কাছ থেকে ১৫ লাখ, এস এম রুহুল আমিন রানার কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকাসহ মোট ১২ কোটি ৬১ লাখ ১৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন শামীম। এ ছাড়া প্রতারণার টাকা থেকে নিজ নামে লালবাগে ৬ তলা বাড়ি, নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ সম্পত্তি, রাজধানীর সবুজবাগে দুটি ফ্ল্যাট এবং সালমা ভূঁইয়ার নামে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছেন।

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের আশঙ্কা এই দম্পতি তাদের নামে থাকা স্থাবর সম্পত্তি অন্যত্র বিক্রি কিংবা হস্তান্তর করার পাঁয়তারা করছেন। এজন্য এসব সম্পত্তি ক্রোক এবং তা ব্যবস্থাপনা বা তদারকি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করার আবেদন করা হয়েছিল। গত সপ্তাহে আদালত তা আমলে নিয়ে আদেশ দিয়েছেন।

সালমা-শামীমের যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ: সিআইডি সূত্র জানায়, আসামি সালমা ও শামীম এবং তাদের সহযোগীরা সিটি ব্যাংকের উত্তরা, মিরপুর, গুলশান ও পল্লবী শাখা, এবি ব্যাংকের মিরপুর শাখা, ইসলামী ব্যাংকের খিলক্ষেত শাখা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের দারুসসালাম শাখাসহ ২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণার টাকা লেনদেন করেন।

সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মামলাটির তদন্ত করে আসামি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টের টাকা যাতে সরাতে না পারে, সেজন্য সেগুলোর লেনদেন স্থায়ীভাবে অবরুদ্ধ করেছেন আদালত। এখন ফ্রিজ করা ব্যাংক হিসাবগুলো বিশ্লেষণ করা হবে।

অবশ্য, সিআইডির অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সালমা-শামীম দম্পতি প্রতারণা করে আসছেন। এরই মধ্যে গ্রামের বাড়িতে অন্তত ৫ কোটি টাকা খরচ করে আলিশান বাড়ি বানিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব অ্যাকাউন্টে খুব বেশি টাকা জমা নেই। তবে তাদের প্রতারণার আয়ের হিসাব মিলবে এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে।

যেভাবে প্রতারণা করেন সালমা-শামীম দম্পতি: তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তা এলাকার ৫ শতাংশ জমির ওপর ৬ তলা পুরোনো বাড়ি রাশেদুল ইসলাম জুয়েলের পৈতৃক সম্পত্তি। সেটি মর্টগেজ দিয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ৮৭ লাখ টাকা লোনও নেন। তিনি কারও কাছে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি না করলেও ‘কাগজপত্রে’ সেটির মালিক শামীম ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি। তিনি ২০১৯ সালে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে সেটি নাকি কিনেছেন। এরপর ওই বাড়ির দলিল দেখিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন দেড় কোটি টাকা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের গাউন ও ব্যাগ লাগবে বলে ব্যবসায়িক অংশীদার শিহাব উদ্দিনকে জানিয়েছিলেন শামীম। তিনি ‘ইসমাইল ট্রেডার্স লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তাকে জানানো হয়, এক কোটি ১০ লাখ টাকা দিলে কাজটি তারা পাবেন। এরপর শিহাবকে হেয়াটসঅ্যাপে কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সঙ্গে ছবি এবং গাউনের নমুনার ছবি পাঠান শামীম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে পরিচালক ‘সেলিম খান’ স্বাক্ষরিত দুটি কার্যাদেশও দেখানো হয়। যেখানে একটি ইসমাইল ট্রেডার্স লিমিটেডের এবং অপরটি অংশীদারের ব্যক্তিগত কোম্পানি জেড টেকনোলজির নামে।

লাভের আশায় শিহাব ঋণ করে এক কোটি ১০ লাখ টাকা দেন শামীমকে। একইভাবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের কার্যাদেশ পাওয়ার তথ্য জানিয়ে হাতিয়ে নেন আরও ২০ লাখ টাকা; কিন্তু কোনো বিল না পেয়ে সন্দেহ হয় শিহাবের। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় দুটিতে যোগাযোগ করে জানতে পারেন শামীমের প্রতিষ্ঠান কাজই পায়নি! এভাবে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অন্তত ৯০টি ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে নগদ ও চেকের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেন শামীম।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, শামীম-সালমা দম্পতির বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ২৯টি মামলার তথ্য মিলেছে। অনেক মামলায় তারা গ্রেপ্তারও হয়েছেন। বেরিয়ে ফের প্রতারণার জাল ফেলেন তারা। এমনকি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করে হয়রানি করেন। এতে তাদের প্রতারণার শিকার অনেকে মামলা করতেও ভয় পান।

শামীমের এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৩ সালেও শামীম, তার বাবা ও ভাইয়েরা সবাই কৃষিকাজ করতেন। দিন এনে দিনে খাওয়ার অবস্থা ছিল তাদের। কৃষক শামীমের বাবা ও ভাইয়েরা এখন চলেন-ফেরেন দামি গাড়িতে। এক ভাই থাকেন বিদেশে। প্রতারণা করতে গিয়েই মধ্যবয়সী সালমার সঙ্গে তার পরিচয়। এরপর বিয়ে করতে হয় তাকে। শেষ পর্যন্ত দুজন মিলে শুরু করেন প্রতারণা। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই দম্পতির কোনো জ্ঞাত আয় ছিল না। ছিল না কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। এর দুই বছরের মাথায় ১৪ লাখ টাকা আয় দেখানো হয় আয়কর নথিতে। সম্পদ উল্লেখ করা হয় ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৮২ হাজার ৯১৮ টাকার। এরপর তারা ফুলেফেঁপে কেবল টাকার কুমির হয়েছেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, শামীম ও তার স্ত্রীর চক্রের সদস্যদের সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে বলে তাদের জানাতেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিতেন। এসব পরিচয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন তারা। ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে ওই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পার্টনারে ব্যবসা করার প্রস্তাব দিতেন। এ ছাড়াও প্রতারক শামীম চক্রে সুন্দরী নারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভুয়া সদস্যও রয়েছে।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।