
সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে সান্ডা এখন সবার চেনা। মরুর দেশের এই গুইসাপ গোত্রীয় প্রাণীটিকে ধরার ভিডিও বর্তমানে ফেসবুকে ভাইরাল। আর তাই সান্ডা নিয়ে পোস্ট, ভিডিও, মিমের ছড়াছড়ি। এর সূত্র ধরেই বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকে ঢুকলেই চোখে পড়ে এক ধরনের বিজ্ঞাপন, ‘মাত্র সাত দিনেই পুরুষত্ব ফিরে পান, সান্ডার তেল ব্যবহার করে দেখুন!’ অনেকে বিশ্বাস করে ফেলছেন, আবার কেউ এটিকে হাস্যরসের খোরাক বানাচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কি এই তেল এতটা কার্যকর? নাকি এটি একটি প্রতারণার নতুন মোড়ক?
সান্ডার তেল কী?
সান্ডার তেল মূলত একটি আয়ুর্বেদিক পণ্য। এটি তৈরি হয় ‘সান্ডা’ নামের মরুভূমি অঞ্চলের গুইসাপ (এক ধরনের মরু গিরগিটি বা মনিটর লিজার্ড) গোত্রীয় প্রাণী থেকে। ভারতে এবং পাকিস্তানে এই তেল দীর্ঘদিন ধরে আয়ুর্বেদিক পণ্য হিসেবে বিক্রি হলেও বাংলাদেশে এটি এসেছে মূলত সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে।
বলা হয়, এই তেল পুরুষদের যৌন ক্ষমতা বাড়ায়, লিঙ্গের আকার বড় করে, স্থায়িত্ব বাড়ায় এবং যৌন দুর্বলতা দূর করে। কিন্তু আসলেই এসব দাবি কতটা সত্য?
সান্ডার তেলের কার্যকারিতা নিয়ে বাস্তব তথ্য এবং বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুবই সীমিত। চলুন এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জেনে নিই-
বাস্তব তথ্য অনুযায়ী এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই:
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সান্ডার তেলের কার্যকারিতা প্রমাণের কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। ইউরোপীয় গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ResearchGate-এ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পুরুষের লিঙ্গ ম্যাসাজের ক্ষেত্রে এই তেল ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে যৌন ক্ষমতা বা লিঙ্গের আকার বাড়ানোর মতো কার্যকর ক্ষমতা এর নেই। এটি কোনো অলৌকিক বা জাদুকরী উপাদান নয়।
আরও একটি প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশে যেসব সান্ডার তেল পাওয়া যায়, সেগুলোর আসল উৎস কী? আদৌ কি এতে সান্ডার কোনো উপাদান থাকে, নাকি এসব কেবল ব্যবসায়িক ছলচাতুরি?
বাজারে পাওয়া অনেক সান্ডার তেলে আসল উপাদান নেই। এই পণ্যের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো এর ভুয়া মার্কেটিং। অজানা পেইজে অভিনেতা, চিকিৎসক বা ইউটিউবারের ছবি ব্যবহার করে বিক্রি বাড়ানো হয়। “ব্যবহারের ৫ দিনেই অলৌকিক ফল!”—এই ধরনের কথা বলে শুধু মানুষকে ধোঁকা দেয়া হয়।
বিপদজনক দিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি
সান্ডার তেলের উপকারিতার কোনো প্রমাণ তো নেই ই বরং কিছু কিছু মানুষের ত্বকে এই তেল ব্যবহারের পর অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই তেল ব্যবহারে ত্বকে জ্বালা, চুলকানি এমনকি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি কাজ করে প্লেসেবো ইফেক্ট অর্থাৎ ব্যবহারকারী ভাবেন এটি কাজ করছে, ফলে কিছুটা মানসিক সন্তুষ্টি অনুভব করেন।
ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ:
শুধু সান্ডার তেল নয়, কোনো ওষুধ বা তেলই শারীরিক প্রয়োজনে ব্যবহার করলে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যবহার করা উচিত নয়। শারীরিক দুর্বলতা বা অন্য কোনো যৌন সমস্যা থাকলে একজন ইউরোলজিস্ট বা যৌন রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এটিই স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও সচেতনতা
বাংলাদেশে যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও ট্যাবু রয়ে গেছে। মানুষ সরাসরি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ইউটিউবের ভিডিও, ফেসবুক পেইজ আর রাস্তার বিজ্ঞাপন দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে সান্ডার তেলের মতো পণ্য সহজেই ভাইরাল হয় এবং মিথ্যে আশায় মানুষ ঠকে যায়।
সান্ডার তেলের বিকল্প উপায়:
যেহেতু সান্ডার তেলের কার্যকারিতার কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই তাই যৌন স্বাস্থ্য বা শক্তি বৃদ্ধি করতে বিকল্প উপায় অবলম্বন করুন। এ ক্ষেত্রে সঠিক জীবনযাপন অনেক বড় প্রভাব রাখে। খাবারদাবার, ঘুম, বিভিন্ন ভালো অভ্যাস এর সঙ্গে জড়িত। চলুন এ সম্পর্কে আরও বিষদ জেনে নিই-
সুষম খাদ্য ও পুষ্টি:
খাদ্যতালিকায় রাখুন পর্যাপ্ত প্রোটিন, দুধ, বাদাম, ডিম, কলা, খেজুর, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার। এসব খাবার যৌন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। দেহে জিঙ্ক এবং ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হলে যৌন দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
ব্যায়াম ও রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি:
যৌন স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চার বিকল্প নেই। নিয়মিত ব্যায়াম (বিশেষ করে স্কোয়াট, কেগেল এক্সারসাইজ) দেহের রক্তপ্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়, যা যৌন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
ওজন নিয়ন্ত্রণ:
স্থূলতা যৌন ক্ষমতা কমাতে পারে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন।
মানসিক চাপ কমানো:
দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বা মানসিক চাপ যৌন উত্তেজনা ও যৌন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই চাপমুক্ত থাকতে চেষ্টা করুন। মেডিটেশন, পর্যাপ্ত ঘুম এবং মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া:
যদি দীর্ঘমেয়াদী যৌন দুর্বলতা বা ইরেকশন সমস্যা হয়, তাহলে একজন ইউরোলজিস্ট বা সেক্সোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা:
অনেক সময় ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হরমোনজনিত সমস্যাও যৌন দুর্বলতার কারণ হতে পারে।
যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে কোনো তেল বা ওষুধ ব্যবহার না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। জীবনযাপনে পরিবর্তন আনুন। পর্যাপ্ত ঘুম আর স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিত করুন।