বাংলাদেশ: ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন সিলেট বিভাগের পাঁচজন। এবারের ভোটে একজন হেরে গেলেও বাকি চারজন নির্বাচিত হয়ে সংসদে আছেন। কিন্তু মন্ত্রী থাকতে পারেননি তাঁদের একজনও। এ নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় চলছে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা। দলের নেতা-কর্মী আর ভোটারদের পর্যবেক্ষণ-অভিযোগ বলছে, আশপাশের লোকজনের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি-অনিয়ম ও অপকর্মে নিশ্চুপ ছিলেন মন্ত্রীরা। এর মধ্যে চার মন্ত্রীর সহকারীরাই গড়ে তোলেন দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির সিন্ডিকেট। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর নির্দিষ্ট কিছু লোক ছাড়া দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব তৈরি হয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে দলের এমপিদের সঙ্গেও বাধে বিরোধ। এসব কারণেই প্রধানমন্ত্রী এবার আর তাঁদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মান্নানের এপিএসের নিয়ন্ত্রণে ছিল সব: ২০০৮ সালে সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-শান্তিগঞ্জ) আসন থেকে প্রথমবার এমপি হন এম এ মান্নান। এরপর ২০১৪ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ও ২০১৮ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। শুরু থেকে সাবেক শিবির নেতা মো. হাসনাত হোসেনকে নিয়োগ দেন একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) হিসেবে। এর পর থেকে দুই উপজেলার সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হাসনাতের হাতে। গড়ে তোলেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। মন্ত্রী যখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত, তখন স্থানীয় প্রশাসনসহ সবকিছুতে প্রভাব বিস্তার করে স্বজনপ্রীতি, সিন্ডিকেট-বাণিজ্য ও নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে দুই উপজেলার সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলেন এই হাসনাত। নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ছোট ভাই নুর হোসেনকে ভাইস চেয়ারম্যান বানান। নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রীর অধিকাংশ প্রোগ্রামে ডানে হাসনাত ও বাঁয়ে নুর হোসেন জায়গা করে নেন। স্থানীয়ভাবে তাঁদের ‘হাবিল-কাবিল’ বলে ডাকা হয়। মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে হাসনাতও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। দলের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সুনামগঞ্জের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন করা সরল-সহজ, সজ্জন মান্নানের সবকিছু ম্লান হয়েছে হাসনাত সিন্ডিকেটের অপকর্মের কারণে। শান্তিগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি বুরহান উদ্দিন দোলন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একদিকে মন্ত্রীর লোকজনদের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে দূরে ঠেলে বিএনপি-জামায়াতকে প্রতিষ্ঠিত করা। এসব নেত্রীর কানে পৌঁছেছে। তা ছাড়া, বয়স্ক হওয়ায় হয়তো তিনি বাদ পড়েছেন।’এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এম এ মান্নান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দু-তিন দিন ধরে এরকম অনেক কথা শুনতেছি। আপনি যাঁদের নাম বলেছেন, তাঁদের ব্যাপারে এর আগে কেউ আমাকে লিখিত বা মৌখিক এ রকম কিছু বলেননি। থাকলে থাকতেও পারে, তবে এসব আমি জানি না।’
মোমেনের বিরুদ্ধে সেই একই অভিযোগ: ২০১৮ সালে সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন এ কে আব্দুল মোমেন। উচ্চশিক্ষিত, সদালাপী মোমেনকে দেওয়া হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিছুদিন পর মোমেনের এপিএস হিসেবে নিয়োগ পান শাফিউল আলম জুয়েল। অভিযোগ ওঠে, জুয়েল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করতেন। এরপর মন্ত্রীর স্ত্রী সেলিনা মোমেন, জুয়েল, জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হেলেন আহমদসহ আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার, মোমেন ফাউন্ডেশনের নামে টিলা ভূমি গ্রাস, উন্নয়ন প্রকল্পে ভাগ-বাঁটোয়ারাসহ নানা অভিযোগ আছে তাঁদের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মন্ত্রীর দূরত্ব সৃষ্টি করে নিজেদের আখের গোছাতে থাকে সেলিনা মোমেন-জুয়েল সিন্ডিকেট। সিলেট সিটির ১৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন রায় বলেন, ‘মন্ত্রীর স্ত্রী বিভিন্ন সময় রাগ-গুস্সা করেছেন। এপিএস জুয়েল দুর্ব্যবহার করেন। দলের নেতা-কর্মীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া আরও অনেক কিছু আছে, সব বলা যাবে না। নেত্রীর কাছে নিশ্চয় এসব গেছে।’তবে সব অভিযোগ মিথ্যা বলে মনে করেন আব্দুল মোমেন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোনো দুর্নীতি নাই, খামোখা এগুলো, বানোয়াট। ম্যাডাম (সেলিনা মোমেন) আর জুয়েলের বিরুদ্ধে এগুলো আন্দাজি অভিযোগ।’
ইমরান আহমদ: সিলেট-৪ আসনে টানা সাতবারের এমপি ইমরান আহমদ। ২০১৯ সালে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী হন। তাঁর শিক্ষা, উন্নয়নবান্ধব ও সরলতার সুযোগে পাথরের রাজ্যখ্যাত সিলেট-৪ আসনে গড়ে ওঠে অসাধু সিন্ডিকেট। আর ইমরানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম টিআর কাবিখা ও চোরাকারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত ভাগ নিতেন বলে অভিযোগ আছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভাগ-বাঁটোয়ারা, তদবির-বাণিজ্যসহ তিন উপজেলায় রাজত্ব করেন। ফলে ইমরানের সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ইমরান আহমদকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। সাড়া দেননি খুদে বার্তায়ও।
শাহাব উদ্দিনের ছেলে ছিলেন সবকিছু: মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা-জুড়ী) আসনের এমপি মো. শাহাব উদ্দিন ২০১৮ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী হন। এমপি থেকে মন্ত্রী হয়ে গত পাঁচ বছরে ১ টাকাও আয় বাড়েনি বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মন্ত্রীর ছেলে জাকির হোসেন জুমন বাবার ক্ষমতার বদৌলতে পুলিশ প্রটোকল নিয়ে ঘুরে বেড়ান এলাকায়। সঙ্গে থাকে গানম্যান। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর নামটি আতঙ্কের। মন্ত্রণালয় পরিচালনায়ও নেপথ্যে তাঁর ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ আছে। শুধু ছেলে নন, মন্ত্রীর ভাই, ভাগনেসহ অন্য স্বজনদের বিরুদ্ধেও পাহাড়ের জায়গা দখল করে বাংলো নির্মাণ, বনের গাছ সাবাড় করে অবৈধ করাতকল, জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরও নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ঠিকাদারি কাজ, ইউপি নির্বাচনে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন, মন্ত্রণালয়ে বদলি-বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।
তবে শাহাব উদ্দিনের দাবি ‘এগুলো পত্রিকায় আন্দাজি লেখে, এ জন্য আলোচনা হচ্ছে। সব মিথ্যা, ভিত্তিহীন, ষড়যন্ত্রমূলক।’
‘বাপ-পুতের’ বিরুদ্ধে ভোটে হেরেছেন মাহবুব আলী: হবিগঞ্জ-৪ আসনে গত ১০ বছরে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তাঁর এপিএস বেলালের বিরুদ্ধেও ঘুষ নিয়ে বিমানে চাকরি, অত্যাচার, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এই অবস্থায় ভোটে হেরেছেন, সংসদ সদস্য পদই খুইয়েছেন তিনি। মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আর কই। হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর চৌধুরীর মতে, মাহবুব আলী জনগণ ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক রেখেছেন, তাঁরা তাঁকে সেভাবেই মূল্য়ায়ন করেছেন। জানতে চাইলে মাহবুব আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে এখন কেন এসব কথা উঠলো? আপনারা সাংবাদিকেরা যাচাই-বাচাই করে দেখুন।’
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |