সারাদেশ: গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে ভারতে অবস্থান করলেও তার সম্বন্ধে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো জানায়নি দেশটি। এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তার কূটনৈতিক বা অফিশিয়াল পাসপোর্ট বাতিল করেছে এবং এই পাসপোর্টে ভারতে অবস্থানের ৪৫ দিনের মেয়াদও ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এতে শেখ হাসিনাার ভারতে অবস্থানের বৈধ ভিত্তিটা কী, সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের সামনে কার্যত তিনটি ‘অপশন’ বা রাস্তা খোলা আছে।
এক. রাজনৈতিক আশ্রয়
দুই. তৃতীয় কোনো দেশে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা এবং
তিন. বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ‘রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের’ পথ তৈরি করা।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র বলছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সুসম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো। তাছাড়া পদত্যাগের পর ভারতে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির সর্বদলীয় বৈঠকে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। ফলে শেখ হাসিনাকে ভারতে রাখার ক্ষেত্রে দেশটির অভ্যন্তরীণ কোনো চাপ নেই। যদিও তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনা যখন দেশত্যাগ করেন, তখন তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বহাল ছিল এবং এটির সুবাদেই তিনি অন্তত ৪৫ দিন বিনাভিসায় ভারতে থাকতে পারেন। সেই মেয়াদও ফুরিয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, তাহলে এখন তিনি কোন স্ট্যাটাসে ভারতে অবস্থান করছেন।
শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশ সরকারের কাছে নরমাল পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার যদি তার নরমাল পাসপোর্টের আবেদন মঞ্জুর না করে, তিনি যদি রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েন, তবে ভারত সরকার তাকে ট্রাভেল আইডেনটিটি কার্ড বা ট্রাভেল পারমিট দিতে পারে, যা দিয়ে তিনি তৃতীয় কোনো দেশে অনায়াসে সফর করতে পারবেন। আর এর মধ্যে যদি তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান এবং ভারত সরকার তা মঞ্জুর করে, তাহলে তার ভিত্তিতে ‘যত দিন খুশি’ তিনি দেশটিতে থাকতে পারবেন।
জানা গেছে, তৃতীয় কোনো দেশে আপাতত শেখ হাসিনার যাওয়ার সুযোগ না হলে ভারতেই অবস্থান করবেন তিনি। এ ব্যাপারে দেশটির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বিবেচিত হতে যাচ্ছে। ভারতে এর আগেও শেখ হাসিনা ও তার পরিবার রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন। তা ছাড়া ১৯৫৯ সালে চীন তিব্বত অধিগ্রহণ করলে দালাইলামাকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। বিশেষ বিবেচনায় তিব্বতের ধর্মগুরু দালাইলামার মতোই শেখ হাসিনাও সেখানে আশ্রয় পাবেন। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশের রাজনীতিবিদদের আশ্রয় দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে ভারতের। এর আগে ১৯৫০ সালে নেপালের মহারাজা ত্রিভুবন বীরবিক্রম শাহকেও আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। ১৯৯২ সালে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল। ২০১৩ সালে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদকেও রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় ভারত। এ ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজনে শেখ হাসিনাকে ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে রেখে দিতে দেশটি যে দ্বিধা করবে না, সেই ইঙ্গিতও কিন্তু দিল্লিতে এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই পদক্ষেপে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়বে সেটাও দিল্লিকে খেয়াল রাখতে হবে। পর্যবেক্ষকরা বলেন, ১৯৫৯ সালে দালাইলামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে ভারত-চীন সম্পর্কে যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল, ৬৫ বছর পরও তার রেশ রয়ে গেছে। ভারতেও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শেখ হাসিনাকে দেশটি যদি আশ্রয় দিয়ে রেখে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেটা অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে।
ইতিমধ্যে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। এটি অনুযায়ী ভারতে যদি আমাদের কোনো দোষী মানুষ থাকেন, তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোন আর যাই হোন না কেন, তার প্রত্যর্পণ আমরা চাইতে পারি। শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে তাকে ফেরত চাওয়া হবে।’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা কোন স্ট্যাটাসে ভারতে রয়েছেন, সেটি আমাদের জানা নেই।’ অবশ্য এর আগে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, যদি আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়, তবে কূটনৈতিকভাবে সেটি দেখা হবে। এদিকে জুলাই গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে একের পর এক হত্যা মামলা হচ্ছে। বিচারকাজে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি উঠেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে। এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে নিয়ে কী ভাবছে, তা স্পষ্ট করেনি দিল্লি। ৪৫ দিন কূটনৈতিক পাসপোর্টের অধীনে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তেমন একটা আলোচনা না হলেও, বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা জোরালো হচ্ছে।
শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিলেও ভারত সরকার বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘আমরা যে সরকার ক্ষমতায় (গভর্নমেন্ট অব দ্য ডে) থাকে, সে সরকারের সঙ্গে কাজ করি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করছি।’তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতন হয়েছিল, ওই আন্দোলনে ভারতবিরোধী একটা সেন্টিমেন্টও ছিল। এ কারণে ভারত যদি তাকে আশ্রয় দেয়, তাহলে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে আরও উসকে দেবে। এ কারণে ভারত চাইবে না বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে এখনই কোনো বৈরী সম্পর্ক তৈরি হোক। শুধু ঢাকা-দিল্লিই নয়, শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে কথা বলছেন বিশ্বনেতারাও। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে মনে করেন, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতেই অবস্থান করা উচিত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। বিক্রমাসিংহে আরও বলেন, ‘আমি যে বিষয়ে অগ্রাধিকার দেব, তা হলো বাংলাদেশ স্থিতিশীল হোক। শেখ হাসিনা যদি দেশের বাইরে থাকতে চান, বাইরেই থাকুক।’
তৃতীয় কোনো বন্ধু দেশে পাঠানো : শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর দেশটির সরকারি বক্তব্য অনুযায়ী তার ভারতে যাওয়াটি ছিল ‘সাময়িক’। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গত ৬ আগস্ট পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিবৃতিতে ‘ফর দ্য মোমেন্ট’ (তখনকার মতো) কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। তারপর থেকে সরকার আর এ বিষয়ে নতুন করে কোনো ভাষ্য দেয়নি। এর কারণ হলো, শেখ হাসিনাকে নিরাপদ কোনো তৃতীয় দেশে পাঠানোর চেষ্টা তারা করছে। বার্তা সংস্থা বিবিসি জানিয়েছে, শেখ হাসিনার যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তাব প্রথমেই বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর ইউএই (সংযুক্ত আরব আমিরাত), সৌদি আরব ও ইউরোপের দু-একটি ছোটখাটো দেশের সঙ্গে ভারত কথা বলেছিল। যদিও এসব আলোচনায় তেমন একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে খবর নেই। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি প্রভাবশালী দেশ কাতারের সঙ্গেও ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। পাশাপাশি এটাও ঠিক, শেখ হাসিনা নিজে এখনো কোনো দেশে ‘লিখিত আবেদন’ করেননি। যুক্তরাজ্য বা আমেরিকায় তো নয়ই, এসব দেশেও না। তার হয়ে এবং তার মৌখিক সম্মতির ভিত্তিতে যাবতীয় কথাবার্তা ভারত সরকারই চালাচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, ‘উই আর হোপিং ফর দ্য বেস্ট, প্রিপেয়ারিং ফর দ্য ওয়েস্ট!’ অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, ভারত এখনো আশা করছে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালোটাই ঘটবে (তৃতীয় কোনো বন্ধুদেশে তিনি গিয়ে থাকতে পারবেন), কিন্তু সেটা যদি কোনো কারণে সম্ভব না হয়, তাহলে সবচেয়ে খারাপটার জন্যও (শেখ হাসিনাকে লম্বা সময়ের জন্য ভারতেই রেখে দিতে হবে) দিল্লি প্রস্তুত থাকবে।
‘রাজনৈতিক কামব্যাকে’ সাহায্য করা : তৃতীয় পথটার হয়তো এখনই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়; কিন্তু ভারতের কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকদের একটা অংশ বিশ্বাস করেন কিছুদিন পর উপযুক্ত পরিস্থিতি এলে শেখ হাসিনার ‘রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনে’র জন্যও ভারত চেষ্টা করতে পারে। কারণ দল বা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ এখনো ফুরিয়ে যায়নি এবং দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে সংগঠনের হাল ধরতেই পারেন। পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা অন্তত তিনবার ‘কামব্যাক’ করেছেন। ’৮১-তে, ’৯৬-তে আর ২০০৮-এ। এই তিনবারই অনেকে ভেবেছিলেন, তার পক্ষে হয়তো ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। কিন্তু প্রতিবারই তিনি তাদের ভুল প্রমাণ করেছেন! এ কারণে শেখ হাসিনা এক দিন বাংলাদেশে ফিরে আবার আওয়ামী লীগের হাল ধরতে পারেন, দিল্লির একটা অংশ খুব ‘সিরিয়াসলি’ বিশ্বাস করেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোয়ও তিনি বিচারের সম্মুখীন হতে পারেন, হয়তো পরবর্তী নির্বাচনে তার লড়ার ক্ষেত্রেও বাধা থাকতে পারে; কিন্তু তার দেশে ফেরার রাস্তা এবং রাজনীতিতে নতুন করে প্রবেশ বন্ধ করাটা কঠিন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়, সারা দেশে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক আছে সেই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা আগামী দিনে বাংলাদেশে ফিরতেই পারেন। তবে কোনো কোনো বিশ্লেষকরা এও মনে করেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পারবে, কিন্তু দলের নেতৃত্বে বড়সড় পরিবর্তন আনা ছাড়া কোনো উপায় নেই!
সূত্র: Daily Janakantha
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |