জাতীয়: বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শরিক দলগুলোকে জায়গা করে দিতে প্রথম বারের মতো নতুন কিছু জায়গায় নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। যার একটি বরিশাল-২ আসন, আর এ নিয়ে সেখানকার আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের মধ্যে বেশ মনোমালিন্য দেখা যাচ্ছে।।
আওয়ামী লীগ জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন গত তিনটি নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন ঢাকার একটি আসন থেকে। এবার তাকে ভিন্ন একটি আসন থেকে প্রার্থী করা হয়েছে, যেটি তার জন্মস্থানও নয়।
বরিশালের আওয়ামী লীগ নেতাদের একটি অংশ বলছেন, হঠাৎ করে ভিন্ন একটি আসন থেকে মি.মেননকে প্রার্থী করায় বিষয়টিকে তারা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না।
এ কারণে তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করছেন আরো দু’জন আওয়ামী লীগ নেতা। নৌকার সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের সংঘর্ষও হয়েছে কয়েক দফা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী তথা আওয়ামী লীগ নেতা ফাইয়াজুল হক বিবিসিকে বলছেন, “রাজনৈতিক নানা সমীকরণে নৌকাকে বর্গা দেয়া হয় অল্প সময়ের জন্য। এবার যেমনটি করা হয়েছে মেননের বেলায়।”
তার মতে, এই ‘জার্সি বদলের রাজনীতিতে’ ক্ষতিগ্রস্ত হবে আওয়ামী লীগই।
তবে রাশেদ খান মেনন নিজে বিবিসিকে বলেছেন, “যারা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, নৌকাকে ভালবাসেন তারা আমার সাথে আছেন।”
সঙ্কটের মূলে যা
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী রাশেদ খান মেনন।
এবার ঢাকার ঐ আসনটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে দলের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমকে। যে কারণে সেখান থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন রাশেদ খান মেনন।
পরে জোটের সিদ্ধান্তে রাশেদ খান মেনন বরিশাল-২ ও বরিশাল-৩ আসন থেকে জোটের মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। ওদিকে বরিশাল-২ আসন থেকে প্রথমে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনূসকে।
রাশেদ খান মেননের নিজ বাড়ি বাবুগঞ্জ উপজেলায়। যেটি পড়েছে বরিশাল-৩ আসনে। সেখান থেকে মনোনয়ন সংগ্রহও করেছিলেন তিনি।
কিন্তু এই আসনটি ছেড়ে দেয়া হয় জাতীয় পার্টিকে। এখান থেকে জাতীয় পার্টি প্রার্থী করে দলের নেতা গোলাম কিবরিয়া টিপুকে।
পরে রাশেদ খান মেনন চূড়ান্তভাবে প্রার্থী হন উজিরপুর-বানারীপাড়া নিয়ে গঠিত বরিশাল-২ আসনে। তাকে জোটের প্রার্থী করায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনূস মনোনয়নন প্রত্যাহার করে নেন দলের সিদ্ধান্তে।
জেলা সাধারণ সম্পাদককে সরিয়ে ভিন্ন উপজেলা থেকে শরিক জোটের নেতাকে নৌকার প্রার্থী করায় ক্ষুব্ধ হন আওয়ামী লীগের একটি অংশ।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল স্তরের একটি অংশ বলছেন, টানা ১৫ বছর ধরে এই আসন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু এখান থেকে হঠাৎ করে প্রার্থী করা হয়েছে ওয়ার্কার্স পাটির নেতাকে। যা নিয়ে ক্ষোভ আছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের।
রাশেদ খান মেনন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমি এবার আসলে নির্বাচনে সেভাবে আগ্রহী ছিলাম না। আমাকে প্রধানমন্ত্রী কেন এখানে পাঠিয়েছেন সেটা আমার নিজেরই জানা নেই!” তবুও এটাকে নিজের জন্য ‘বড় পাওনা’ বলে মনে করেন মি. মেনন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সংগঠন নিয়ে প্রশ্ন
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছে চেয়েছিল মোট ২০টি আসন। এই আসনগুলো থেকে তারা নৌকা মার্কায় নির্বাচন করার কথা জানায় আওয়ামী লীগকে।
তবে গত ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে যখন সারা দেশের নৌকা প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয় তখন দেখা যায় ১৪ দলের শরিকদের জন্য আসন ছাড়া হয়েছে মাত্র ৬টি। যার একটি বরিশাল-২।
উজিরপুর-বানারীপাড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ফলে এই আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাংগঠনিক কাঠামো খুব একটা শক্তিশালী নয়।
যে কারণে রাশেদ খান মেনন এখানকার প্রার্থী হওয়ার পর তাকে পুরোপুরি ভরসা করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগের ওপর। রাশেদ খান মেনন বলেন, “গতবার নির্বাচনে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো বিএনপি-জামায়াত। এবার প্রতিপক্ষ জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্র। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই ষড়যন্ত্রকে পরাজিত করতেই ভোট করছি আমরা।”
মি. মেনন আরও বলেন, “যারা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও নৌকাকে ভালবাসেন, তারা আমার সাথে আছেন। আওয়ামী লীগ সংগঠিত দল, এর বাইরে গিয়ে কাজ করার কোন সুযোগ নাই।”
“আমি ও আমার দলের সাধারণ সম্পাদক বাদশা বাদে সবাই দলীয় প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশগ্রহণ করছে। এটা আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই করেছি। আমরা মনে করেছি এটা রাজনৈতিক জোট। এর সাথে আদর্শ ও কর্মসূচি জড়িত”, বলছিলেন মি. মেনন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটা অংশ মূলত এই ইস্যুতেই কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে রয়েছেন। কেন না তারা বলছেন, এই আসনে ওয়ার্কার্স পার্টি সাংগঠনিকভাবে অনেকটা নাজুক অবস্থানে। যে কারণে, নির্বাচনে জয়ী হতে হলে পুরোপুরি ভরসা করতে হবে আওয়ামী লীগের ওপর।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো ইউনুস বিবিসিকে বলেন, “আমাদের মধ্যে কষ্ট থাকলেও প্রধানমন্ত্রী যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তাকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের।”
মেননের পুরনো বেফাঁস মন্তব্য
২০১৯ সালে বরিশালে জেলা ওয়ার্কার্স পাটির এক অনুষ্ঠানে দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন অভিযোগ করেছিলেন, “জনগণ একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে দিতে পারে নাই। আমি সাক্ষী দিয়ে বলছি, ওই নির্বাচনে আমিও নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু জনগণ ভোট দিতে পারেনি।”
তখন মেননের এই বক্তব্য নিয়ে দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বেশ অস্বস্তিতে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তার এই বক্তব্যের জন্য শরিক দলের তোপের মুখেও পড়তে হয় মি. মেননকে।
যদিও এই বক্তব্যের পর এ নিয়ে তার দল ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা মি মেনন নিজেও তেমন কোনও ব্যাখ্যা দেননি। এবার নির্বাচনের মাঠে মি. মেনন প্রার্থী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের একটি অংশ ভোটের মাঠে বিষয়টি নিয়ে বেশ সরব।
নির্বাচনে মাঠে নৌকা মার্কার প্রতিদ্বন্দ্বী ফাইয়াজুল হক বিবিসিকে বলছেন, “আওয়ামী লীগ আর সরকারকে ব্যবহার করে রাশেদ খান মেনন রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ অপমানবোধ করলেও মেনন সাহেব ক্ষমা চাননি। কিংবা এ নিয়ে কোনও ব্যাখ্যাও দেননি।”
ভোটের লড়াইতে আওয়ামী লীগ নেতারাও
এই আসনে আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থানের পরও ওয়ার্কার্স পার্টিকে জোটের প্রার্থী করার বিষয়টি সহজভাবে নেননি স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটা অংশ।
এ কারণে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের দুইজন নেতা। ফাইয়াজুল হক আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটির সহ-সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তার পিতা ফায়জুল হকও ছিলেন এই আসনের চার বারের সংসদ সদস্য।
তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন, জড়িত স্থানীয় রাজনীতিতেও। এবার রাশেদ খান মেননের মুল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তাকেই ভাবা হচ্ছে এলাকায়।
ফাইয়াজুল হক বলেন, “রাজনৈতিক নানা সমীকরণে নৌকাকে কখনো কখনো বর্গা দেয়া হয় অল্প সময়ের জন্য। এবার যেমনটি করা হয়েছে রাশেদ খান মেননের বেলায়।”
তবে জোটের প্রার্থীকে এখানে নৌকার প্রার্থী করায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ, বলছিলেন মি. হক। এই আসনের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলাম। তার দাবি ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই’ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, “স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে আমাকে নৌকা মার্কা দেয়া হয়নি।”
প্রচারণার প্রথম দিন থেকেই সংঘর্ষ
গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পরই নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন প্রার্থীরা।
ঐদিন বিকেলে বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের মতবিনিময় সভায় যোগ দেন রাশেদ খান মেনন। তার সামনেই আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি ও সংষর্ঘের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ, গত মঙ্গলবার দুপুরে নৌকা প্রার্থী রাশেদ খান মেনন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাইয়াজুল হকের কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। এই সংঘর্ষে পুড়িয়ে দেয়া হয় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল; আহতও হন অনেকেই।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাইয়াজুল হক অভিযোগ করছেন, তার নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে নৌকা মার্কার কর্মী সমর্থকরা। ভোটকে প্রভাবিত করতেই শুরু থেকেই কূটকৌশল চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ মি. হকের।
বিবিসি বাংলাকে ফাইয়াজুল হক বলেন, “ভোটার ও দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা, প্রভাবিত করা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের ডিস্টার্বও করা হচ্ছে।”
রাশেদ খান মেনন আবার বলেন, “নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয় সে কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এলাউ করেছিলেন। এতে প্রথম দিকে কিছু কনফিউশন ছিলো, পরবর্তীতে এ কনফিউশন দূর হয়েছে।”
যা বলছেন সাধারণ ভোটাররা
উজিরপুর আর বানারীপাড়ার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে প্রবল খরস্রোতা সন্ধ্যা নদী। প্রতি বছর বর্ষায় ভাঙ্গনে অনেক ঘরবাড়ি বিলীন হয় এই নদীগর্ভে।
এই নদীতেই ঘরবাড়ি হারিয়েছেন এলাকার বহু পরিবার। ভোটাররা জানান, প্রতি ভোটের আগে নানা আশ্বাস মেলে প্রার্থীদের। তবে তারা যে প্রতিশ্রুতি দেন সেটি যেন বাস্তবায়ন করেন তারা!
চল্লিশোর্ধ্ব জাহানারা বেগম বলছিলেন, ‘আগে নির্বাচন আসলে ঈদের খুশি লাগতো এলাকায়, এখন আর সেই আগের ভোট নাই।”
গৃহিণী শিমুর মতে, শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থান-সহ গ্রামীণ নারীদের নানা চাহিদা থাকে। “কিন্তু সে সব শুধু আলোচনা হয় ভোটের সময়। সেগুলোর বাস্তবায়নও জরুরি”, যোগ করেন তিনি।
সাতই জানুয়ারির ভোটে বিএনপি জোটের অংশগ্রহণ নেই। তাই এই ভোট নিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের আগ্রহ খুব একটা বেশি নয়। তবে তারা বলছেন যারাই ভোটে জিতুক তারা যেন নজর দেন তৃণমূলের উন্নয়নে। পাশে থাকেন ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |