সিয়াম পালনকারীরা রমজানের সিয়াম ও কিয়াম পূর্ণ করার মাধ্যমে তাদের ওপর অর্পিত আমল আদায়ের কর্তব্য পালন করেছে। যখন তারা ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাতে বের হয়েছে, তখন তাদের প্রতিদানগুলো তাদের ওপর বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা পরিপূর্ণ প্রতিদান প্রাপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
যে পূর্ণরূপে আদায় করেছে, তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেয়া হয়েছে, যে ব্যক্তি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণরূপে বুঝিয়ে দিয়েছে, তাকে পূর্ণ বিনিময় দান করা হয়েছে। যে কম করেছে, সে কম পেয়েছে। আর যে ব্যক্তি ওজনে কম দেয় আপনারা তো জানেন ওজনে কম দানকারীদের ব্যাপারে কী বলা হয়েছে। সে ব্যক্তির কি লজ্জাবোধ হয় না যে তার প্রবৃত্তির মাপ পূর্ণমাত্রায় দেয়, অথচ সে তার সিয়াম ও কিয়ামের মাপে কম দেয়!!! এটা তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট চুরি। মহান আল্লাহ বলেন: ‘কাজেই দুর্ভোগ সে সালাত আদায়কারীদের, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন।’ (সুরা আল-মাঊন: ৪-৫)
সালাফে সালেহিন পূর্ণরূপে ও বিশুদ্ধভাবে আমল করার চেষ্টা করতেন, অতঃপর তারা তা কবুল হওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত থাকতেন এবং প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা করতেন। মহান আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয় যারা তাদের রবের ভয়ে সন্ত্রস্ত, আর যারা তাদের রবের নিদর্শনাবলিতে ঈমান আনে এবং যারা তাদের রবের সঙ্গে শিরক করে না, আর যারা যা দান করে তা ভীত-কম্পিত হূদয়ে করে থাকে এজন্য যে, তারা তাদের রবের দিকে প্রত্যাবর্তনশীল। তারাই কল্যাণকর কাজ দ্রুত সম্পাদন করে এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়।’ (সুরা আল-মুমিনুন: ৫৭-৬১)
তারা আমল সম্পাদনের চেয়ে আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারে অধিক গুরুত্ব দিতেন। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকীদের পক্ষ হতে কবুল করেন।’ (সুরা আল-মায়েদা: ২৭) সুতরাং তাদের নিকট সরিষার দানা পরিমাণ আমল কবুল হওয়া দুনিয়া ও দুনিয়ার মাঝে যা কিছু আছে তার চেয়ে বেশি প্রিয় ছিল। সুতরাং সতর্ক থাকতে হবে যেন আমল একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হয় এবং তা কবুল না হওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কায় থাকতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসকে একটি ক্ষেত্র বানিয়েছেন যেন মানুষরা এই মাসে তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদতে প্রতিযোগিতা করতে পারে। কাজেই একদল লোক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে সফলকাম হয়েছে, আর অন্যদল পরাজিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুতরাং বিস্ময় সে প্রতিযোগীর জন্য যে সেই দিনে হাস্যোজ্জ্বল হবে, যেদিন সৎকর্মশীলরা সফলকাম হবে আর বাতিলরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই আমাদের মাঝে যারা মাকবুলদের অন্তর্ভুক্ত তাদেরকে অভিবাদন জানাই, আর যারা বঞ্চিত তাদের সমবেদনা জানাই।
যাকে তার মাওলা জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন, আপনি স্বাধীন হওয়ার পর পাপের পরাধীনতায় ফিরে যাবেন না। আপনার মাওলা আপনাকে জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন তারপরও কি আপনি এর নিকটবর্তী হবেন? তিনি আপনাকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করছেন আর আপনি তা থেকে দূরে না গিয়ে তাতেই পতিত হতে চাচ্ছেন!!!
যদিও আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের জন্য তবুও অসৎকর্মশীলরা যেন নিরাশ না হয়, যদিও ক্ষমা মুত্তাকীদের জন্য লিপিবদ্ধ তথাপি নিজের প্রতি অত্যাচারীরা তা থেকে বঞ্চিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আয-যুমার: ৫৩)
সুতরাং আপনি আপনার মাওলার ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করুন ও তাঁর নিকট তওবা করুন, কেননা আল্লাহর নিকট কেবল ধ্বংস প্রাপ্তরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সকল সৎ আমলের সমাপ্তি হলো ইস্তেগফার করা। আমরা এর মাধ্যমে আমাদের সালাত, হজ, কিয়ামুল্লাইল ও মজলিস সমাপ্ত করি। যদি সে মজলিস জিকিরের মজলিস হয় তবে তা তার জন্য মহর স্বরূপ, আর যদি বাজে কথার মজলিস হয় তবে তা কাফফারা স্বরূপ। আমাদের সিয়ামের জন্য প্রয়োজন উপকারী ইস্তেগফার ও সুপারিশকারী সৎ আমল; কেননা আমাদের আমলের ক্ষত বিশাল আকার ধারণ করেছে। সৎ কর্মের সুঁই দ্বারা আমরা কত ক্ষতই তো সেলাই করি, কিন্তু পরবর্তী পাপের ধার দ্বারা তা নষ্ট করে ফেলি।
সবচেয়ে উপকারী ইস্তেগফার হলো তওবা সহকারে ইস্তেগফার করা; পুনরায় পাপ করার ইচ্ছাকে শেষ করে দেয়া। বস্তুত যে লোক মুখে ইস্তেগফার করে কিন্তু তার অন্তরে পাপ কাজের প্রতি দৃঢ় সংকল্প থাকে এবং তার ইচ্ছা একমাস পর আবারও সে পাপকাজে ফিরে আসবে, তবে তার সিয়াম প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং তার জন্য কবুলের দ্বার বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রমজান পরবর্তীতে পুনরায় সিয়াম ও ইবাদতে মশগুল থাকা, সিয়াম কবুল হওয়ার আলামত। সুতরাং নেক কাজের প্রতিফল হলো পরবর্তীতে আরও নেক কাজ করা এবং নেক কাজ অগ্রহণযোগ্য হওয়ার আলামত হলো পরবর্তীতে খারাপ কাজ করা। আর ভালো কাজে অটল থাকা আল্লাহর ক্ষমার নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন সেজন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা আল-বাকারা: ১৮৫)
রমজান মাসের সমাপ্তিতে সৎ আমলসমূহ শেষ হয়ে যায় না। বরং তা বান্দার জীবিত থাকা অবধি বাকি থাকে। সুতরাং তা তার সারা জীবনের সঙ্গী। সেসব লোক কতই না নিকৃষ্ট যারা রমজান মাস ব্যতীত আল্লাহকে যথাযথভাবে চিনতে পারে না। কাজেই আপনি রবের বান্দা হোন, রমজানের নয়। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আর আপনার মৃত্যু আসা পর্যন্ত আপনি আপনার রবের ইবাদত করুন।’ (সুরা আল-হিজর: ৯৯)
দ্বিতীয় খুতবা
হে মুসলিমগণ! রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসের সিয়াম পালন করল, তারপর শাওয়াল মাসে ছয়টি সিয়াম পালন করল, সে যেন সারা বছর সিয়াম পালন করল।’ (সহিহ মুসলিম)
উত্তম হলো কাজা হওয়া ফরজ সিয়াম পালন করার পর তা পালন করা। এটি লাগাতার ছয়দিন কিংবা পুরো মাসে বিরতি দিয়ে দিয়ে আদায় করার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। তবে সৎকাজে অগ্রগামী হওয়া ও প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত থাকার দিক থেকে তা ধারাবাহিকভাবে আদায় করা উত্তম। মাসের শুরুর দিকে যদি পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে সময় কাটায় অতঃপর সিয়াম শুরু করে তবে তা ভালো। কোনো কোনো সালাফ থেকে পুরো শাওয়াল মাস বা শাওয়াল মাসের অধিকাংশ দিন সিয়াম পালন করার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
রমজান মাসের সঙ্গে শাওয়ালের ছয়টি সিয়াম পালন সারা বছর সিয়াম পালন করার সমান, কেননা নেককাজ দশগুণ করে বৃদ্ধি পায়। সুতরাং রমজানের সিয়াম দশ মাসের সমান এবং ছয়টি সিয়াম দুই মাসের সমান। কাজেই তা সারা বছর সিয়াম পালনের সমান। আর এই ফজিলত অর্জিত হবে যদিও রমজান মাস ২৯ দিনের হয়। আর শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম পালনের বৈশিষ্ট্য হলো তা সারা বছর ফরজ সিয়াম পালন করার সমান (রমজানের সঙ্গে)। যদি শাওয়াল ছাড়া অন্য মাসে রোজা রাখা হয়, তবে এ ফজিলত অর্জিত হয় না। এই সিয়াম পালন সালাত পরবর্তী নিয়মিত সুন্নাতের মতো; যার মাধ্যমে ফরজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো মিটিয়ে দেয়া হয়।
(১২ এপ্রিল মদিনার মসজিদে নববিতে দেয়া জুমার খুতবার অনুবাদ)
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |