প্রচ্ছদ সারাদেশ যে দৃশ্যটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, কি ঘটেছিল সেদিন?

যে দৃশ্যটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, কি ঘটেছিল সেদিন?

সারাদেশ: আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আদালত চত্বরের একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়। যেখানে দেখা যায়, একজন যুবককে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে মুখে মাস্ক ও চোখে সানগ্লাস পরা এক নারীকে দেখা যায়- যিনি ওই যুবকের পিঠ চাপড়ে সাহস জোগাচ্ছেন। এক মুহূর্তে কথোপকোথনও হয় তাদের মধ্যে। পরবর্তীতে সামনে আসে ওই মা ও ছেলের পরিচয়। তারা হলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর স্ত্রী-সন্তান। কালবেলার মুখোমুখি হয়েছেন তারা। সাক্ষাৎকারে জানব, কীভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, রিমান্ডে কী হয়েছিল এবং আদালত চত্বরে ঠিক কী কথা হয়েছিল এই মা ও ছেলের মাঝে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অন্তু মুজাহিদ।

আদালত চত্বরে ভাইরাল ওই যুবকের নাম ওমর শরীফ মো. ইমরান। ডাকনাম সানিয়াত। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু ও শামীমা আক্তার লাকী দম্পতির বড় ছেলে। পড়ালেখার হাতেখড়ি অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে। পরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যানেজমেন্টে স্নাতক এবং স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের আইবিএ ফ্যাকাল্টি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। এরপর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে এমবিএ করেন। বর্তমানে বিস্কুট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অলিম্পিকে চিফ কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।

তিনি ২০০৯ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিকে প্রবেশ করেন। বর্তমানে বেগমগঞ্জ উপজেলা বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনে পিছনের সারি থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। যার প্রেক্ষিতে গত ২৩ জুলাই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি পরিবারের। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় কারামুক্ত হন সানিয়াত।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন আপনার সঙ্গে কি ঘটেছিল?

ওমর শরীফ মো. ইমরান (সানিয়াত) : আমাকে তুলে নিয়ে যায় মূলত ২৩ জুলাই রাতে। আমার মা তখন হসপিটালে। বাবা বাসায় ছিলেন না। মেজো ভাইটা একটু ডাউনসিনট্রোম তো, হঠাৎ রাতের বেলা একটু পেস্ট্রি খাবে বলে জিদ ধরেছিল। তো আমি বাধ্য হয়ে বসুন্ধরায় নর্থ-সাউথের পাশে একটা দোকানে ফোনে অর্ডার দিয়ে পেস্ট্রি নিতে যাই। পেস্ট্রি নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গাড়ির দরজা খুলেছি এসময় হঠাৎ দেখলাম অনেকগুলো গাড়ি এলো। পিছনের গাড়িগুলো আমি দেখছিলাম, কারণ ওগুলোর দরজা খোলা, অস্ত্র ওপেন তাক করা। ওটা দেখতে দেখতে সামনের গাড়িগুলো টের পাইনি। সামনের গাড়ি থেকে নেমে পিছনে অস্ত্র ঠেকিয়ে বলল, নাম কি? একটু চুপ ছিলাম। বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক কী হচ্ছে। বললাম, আমার নাম শরীফ মোহাম্মদ ইমরান। বলে আর কী নাম আছে? বললাম, সানিয়াত। সানিয়াত বলার পর ঘাড়টা ধরে একজন বলে, স্যার, এইটাই! টেনে নিয়ে আমাকে তাদের গাড়িতে উঠালো। পরে তারা বিভিন্ন জায়গায় ফোন করলেন। ওরা ওখানে আমাকে নিয়ে অনেকক্ষণ ছিল। আমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, আমার মা অসুস্থ। ফরাজি হাসপাতালে আছেন। বাবা কই, আমি বললাম আব্বাও ওখানে। বলে শিওর? বললাম, তিন দিন আগে কথা হয়েছে। তখন বলে, কেমন ছেলে যে তিন দিন আগে কথা হয়েছে? তখন বললাম, কেমন ছেলে ঠিক বলতে পারব না। তবে বাবা-মার কাছে আমি খুব ভালো ছেলে। কথা হয়েছে কি হয় নাই এটা বলে তো লাভ নেই। তখন বলে, কথাবার্তা ঠিকমতো কইরা বইলো। তারেক রহমানের কোমর ভাঙছে দেখ নাই? তারপর আমি তার সঙ্গে আর কোনো কথা বলিনি।

পরে আমাকে নিয়ে গেল ফরাজি হাসপাতালে। ভাটারা থানার সামনে যখন গেল দেখলাম তারা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলছে, সানিয়াতকে ধরছি, সানিয়াতকে ধরছি। তারা খুব খুশি। আমি খুব অবাক হলাম, ব্যাপারটা কি? পরে ফরাজি হাসপাতালের নিচে আমাকে রেখে তারা উপরে গেল। একেবারে ভেস্ট পরে মনে হচ্ছে যেন তারা বিশাল অপারেশনে যাচ্ছে। ১৫-২০ মিনিট পরে দেখলাম যে আমার সঙ্গে যারা ছিল তারা আর উঠেনি। আরেক গ্রুপ আমার সঙ্গে উঠল। এরপর বসুন্ধরায় এলো। আসতে আসতে আমার কোমরে বেল্ট দেখে তারা আবার অস্ত্র বের করছে। বলে যে, এইটা কি? আমি বললাম এটা বেল্ট। আমার স্পাইনে সমস্যা। বলে অস্ত্র নাই? আমি বললাম ভাই, এটা স্পাইনের সমস্যার জন্য। বলে, বৈধ অস্ত্র নাই। লাইসেন্স করা। আমি বললাম না, কোনো অস্ত্র নাই। বলে, কি রাজনীতিবিদের ছেলে হইলা যে অস্ত্র নাই। আমার মনটা খারাপ হলো, রাজনীতিবিদের ছেলে হলেই অস্ত্রবাজি করতে হবে? ওখান থেকে আমাকে ডিবি অফিসের দিকে নিয়ে গেল।

আপনাকে কোর্টে তোলার যে দৃশ্যটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, কি ঘটেছিল সেদিন?

ওমর শরীফ মো. ইমরান (সানিয়াত): ওইদিন ২৫ জুলাই ছিল। সেদিন দুপুরবেলা আমাকে কোর্টে নিয়ে আসা হয়েছিল। নামানোর পর গারদে রাখা হয়। গারদ থেকে যখন কোর্টে নিয়ে আসছিল তখন আমি একটু চুপচাপ ছিলাম। কারণ, এর আগের দিন ওই যে কথাবার্তা বলছিলাম। তারা হাইপার করে, প্রতিউত্তর দিতে গেলে মারে। তারা আমার কাঁধ, কান, চোয়াল সব জায়গায় মেরেছে। তো আমি একটা জিনিস জানতাম যে, মা হসপিটালে। আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম আম্মা যেন না আসে বা না দেখে আমাকে। পিছন থেকে হঠাৎ করে আম্মা এলেন। একজন বললেন যে, আপনার আম্মা আসছে। এটা মনে হয় এক সেকেন্ডও লাগে নাই। আমার টোটাল নিজের ভিতরে যা কমতি ছিল, এক সেকেন্ড লাগে নাই আমার পুরোটা ফিলাপ হতে। একনজর দেখলাম আমার মাকে, এরপর দুই দিনের মাইরের এনার্জি নিয়ে আমি ছিলাম। এতটুকুই আমি বলতে পারব।

আদালত চত্বরে মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?

ওমর শরীফ মো. ইমরান (সানিয়াত): আমি আম্মাকে দেখে সালাম দিলাম। সালাম দিতে গিয়ে আমার খেয়াল নাই যে আমার হাত বাধা। হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো। হাত উঠায়ে সালাম দিতে গিয়ে দুটো হাত উঠে গিয়েছে আমার। মা যখন বলছেন, নো টেনশন। তখনই আমি যা পাওয়ার পেয়ে গেছি। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী। যা শক্তি পাওয়ার ওই মুহূর্তে পেয়ে গেছি। ওই সময়টা ৮-১০ সেকেন্ডের বেশি হবে না। পরবর্তী রিমান্ড পর্যন্ত কিন্তু ওটাই শেষ দেখা ছিল। আর কিন্তু দেখা হয়নি।

কোর্টের ওই ভিডিও দৃশ্য ছড়িয়ে পড়লে রিমান্ডে আপনার সঙ্গে ঠিক কি হয়েছিল?

ওমর শরীফ মো. ইমরান (সানিয়াত): ২৫ তারিখ থেকে মূলত তারা বলার চেষ্টা করছিল যে, তারেক রহমানের মতো আমারও কোমর ভেঙে দেওয়া হবে। আবার বলে, তারেক রহমানের সঙ্গে তো ভালো খাতির। টেলিফোনে কথাবার্তা হয়। আমি চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম উনার দিকে। বলে, কোনো দিন দেখা হয়নি বা কথাবার্তা হয়নি? আমি বললাম, ২০২২ সালে যখন আমার ছোট ভাই গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে তখন সভায় উনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। ডে ওয়ান থেকে শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ। ২৫ তারিখের পর থেকে তারেক রহমানের সঙ্গে কবে দেখা হয়েছে, লন্ডনের মিটিংয়ে কে কে ছিল, কি কি আনছো, রামপুরায় কে কে ছিল, এর নাম বলতেছে, ওর নাম বলতেছে। তাদের কথা হচ্ছে, রামপুরা থেকে উত্তরা যা কিছু হয়েছে, দেশনায়ক তারেক রহমানের ফান্ডিংয়ে এবং উনার ইশারায় আমি এবং উত্তরা মহানগরের এস এম জাহাঙ্গীর আঙ্কেল নাকি এক্সিকিউট করেছি। রামপুরা থেকে শুরু করে উত্তরা সেতু ভবন বলেন যা কিছু হয়েছে সবকিছু নাকি আমরা করেছি। উত্তর দিলেও মাইর, চুপ থাকলেও মাইর, চিৎকার করলেও মাইর, শরীর নাড়াচাড়া করলেও মাইর নিয়মিত চলছে তো চলছেই। প্রথম দিন প্রথম ২০ মিনিট বুঝতেই পারি নাই। চিল্লাচ্ছি সেটা ঠিক আছে। যে মারতেছে টা কেন? কারণটা কি? পরে আবার শুনলাম ডিজিএফআই ওখান থেকে বলেছে, আমি ঢাকা উত্তর হয়ে নোয়াখালী-ফেনীমুখী যা হয়েছে যেহেতু আমার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে, এখানে পুরো দায়িত্বে আমি ছিলাম। মারার সময় তারা তো দুজন দুজন করে মারে। আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ধরে মারে। দুজন যায় আবার দুজন আসে। তাদের ক্লান্তি আছে কিন্তু আমাদের কোনো ক্লান্তি নাই। দুটো জিনিস মেনটেইন করা হতো। এক শরীরের কোথাও দাগ পড়া যাবে না, আর পানি খাওয়ানো যাবে না। এটা সবচেয়ে কড়া নিয়ম।

তৃতীয় দিনে এসে বলে, আজ আপনাকে যা বাঁচাইতাম, বাঁচাইতে পারব না। আপনার মা যে আজ কোর্টে আসছে। আমি বললাম, আপনারাই তো জানেন যে আমার মা হাসপাতাল থেকে কোর্টে আসছে। বলে, এই ভিডিও করার কি দরকার ছিল। আমি বলি, কোন ভিডিও। উনারা যেভাবে কথা বলে, মনে হয় ডুয়েল পার্সন সিনড্রোমের রোগী। সবগুলো যেন এক একটা অমানুষ। এই ভালো কথা বলতেছে আবার ১০ মিনিট পর ওই আমাকে মারতেছে। আমি তো গলা বুঝতেছি যে একই ব্যক্তি। বলে, আপনাকে তো আর সেইফ করতে পারলাম না। স্যাররা সবাই খুব খ্যাপা। এই ভিডিও আপনার মাসহ। আমি বলি, ভাই, কোন ভিডিও? আসলে ভিডিও কোনটা আমি তো ভিতর থেকে কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি চিন্তা করতেছি। ভিডিওটা কি তারা করল, নাকি নতুন কোনো কিছু আবার আনলো কিনা। যেখানে একটু কথা বললেই মারে। এমনিতেই তারা যা করে, পরে আমি শুনেছি ওই দিন নাকি আমাকে ৯ জন মিলে মারছে। ওইদিন আমার সেন্স না থাকার মতো অবস্থা। সেন্স আসলে বলে নাপা খাও। আমি বলি, কিছু খাই নাই। বলে, না, এই ওষুধ এমনিই খাওয়া যায়, নাপা। আমি বলছি, ভাই এখন খাবো না। এরপর গালি দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোর করে নাপা ওষুধ খাওয়ায়? পরে জানলাম, এগুলো নাপাও ছিল না। এগুলো সিজোফ্রেনিয়া মানসিক রোগের ওষুধ আরকি। দুবার ইনজেকশনও পুষ করা হয়েছে। ওইদিন আবার আমাকে যে কখন নিয়ে গেছে, ঠিকমতো মনে নাই।

রিমান্ডের চতুর্থ দিন, এটার থেকে আরও ১০ গুণেরও বেশি নির্যাতন করা হয়েছে। যখন নির্যাতন করত তার আগে চোখ বেঁধে নিত। এমনভাবে চোখ বাঁধত মনে হতো চোখ দুটো বের হয়ে যাবে এমন। জম টুপি পরানো থাকলে হাতে হ্যান্ডকাপ দেওয়া থাকত। আর চোখ গামছা দিয়ে বাঁধলে হাতও গামছা দিয়ে বাঁধা হতো। কারণ, তখন উপরে ঝুলাইতো। প্রতিটি রিমান্ডে মারার দৃশ্য ভিডিও করে ডিবি প্রধানকে দেখাতে হতো। দুপুর আড়াইটার দিকে একজন এলো। এসে ধাম করে ফুটবলের মতো করে লাথি মারল। এরপর উপরে ঝুলিয়ে দিল। ঝুলিয়ে দিলে যেটা হয় কেবল দুই পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি মাটিতে ছুঁই ছুঁই থাকে। আর পুরো শরীর ঝুলে থাকে। এরপর দুজন এসে গালি দিল। আমি তখন আমার ডান পায়ের হাঁটুর হাঁও বলতে পারিনি। এরই মধ্যে ডান পায়ের গোড়ালিতে টানা ১০ মিনিট ধরে পিটাইছে। শুধু এখানে। তার ক্ষোভ, তার সারাদিন ডিউটি ছিল। রাতের বেলা আবার তাকে আনা হয়েছে। সকালে আবার তাকে আসতে হবে। যার যা ব্যক্তিগত সমস্যা সেটার ক্ষোভও আমাদের ওপর উঠাইছে। এরপর আরেকজন আমার পায়ের গোড়ালিতে ফুটবল প্র্যাকটিস করত। পেনাল্টি শট প্র্যাকটিস করত। বুট দিয়ে গোড়ালিতে ৫০-৬০টা লাথি দিয়েছে। এখন গোড়ালি দেবে গেছে। একটা আঙ্গুল অবশ হয়ে গেছে। পরে ফজরের আজানের সময় আমাকে নেওয়া হচ্ছিল। তখন আমাকে যিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি বললেন, ভাই একটু বুদ্ধির সঙ্গে কাজ করতে হয়। বললাম, কি বুদ্ধি? বলে, এখানে আসার সময় একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতা তাহলে হারুন স্যার দেখলে আর ডাকত না। মানে আমি যে একটু নরমালভাবে হেঁটে গেছি, সেটা তার পছন্দ হয়নি। একটা হচ্ছে বিএনপির ঘটনা আবার দ্বিতীয়ত ওই ভিডিওটা। কিন্তু তখনো আমি ভিডিরও বিষয়ে কিছুই জানি না।

তবে এর পরের দিন অর্থাৎ পঞ্চম দিন। সাইন্সল্যাবে যখন আবার আন্দোলন শুরু হলো, সব শিক্ষার্থী আবার একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেখান থেকে ১৪ জনকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। ওই ছেলেগুলোকে যখন দেখলাম ডাক দিলাম। একজনের নাম আরাভ, অপরজন সাফওয়ান। জিজ্ঞেস করলাম যে কি হয়েছে? বলে, ভাইয়া, আপনার চেহারাটা খুব চেনা চেনা! একটা ভিডিও দেখেছি যেখানে আপনার চেহারার খুব মিল। ভিডিও শোনার পর এদিকে ভিডিও ভিডিও আওয়াজ উঠে গেছে। বলে, একজন মা পিছন থেকে সাহস দিচ্ছে তার ছেলেকে। আপনারও তো কালো গেঞ্জি পরা। আমি বলছি, তাই নাকি? বলল, এটা আমাদের জন্য একটা অনুপ্রেরণা। এটা আমাদের জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করেছে। আমার মা তিন দিন যাবৎ আমাকে বের হতে দেয়নি। এই ভিডিও দেখার পর আমার মা তো আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। দুদিন পর বাবাসহ মা নিজেও রাস্তায় নেমে আসছে। অনেক ভালো লাগছে।

আমাদের কাছে আন্দোলনটা গত ১৭ বছরে কিন্তু অনেক কিছু। জাহাঙ্গীর আঙ্কেল আমাকে বলেছেন, সানিয়াত, কেন জানি মনে হয় তোমার আর আমার একটা কেস আছে। যাওয়ার পরে মেট্রোরেলে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আমি ২৭নং আসামি। ওই মামলায় ৬০০ জনেরও বেশি আসামি। পরে মেট্রোরেলে আগুনের মামলায় আমাদের রিমান্ড আবেদন করা হলো। আমার না নিজের ওপর খুব মায়া লাগছে। আমি যা দেখছিলাম, তখন আমার খেয়াল হচ্ছিল যে প্রথম যে চোখ বাঁধে, তখন রিমান্ড আসে নাই। এই গালিগালাজ এসবের মাধ্যমে তারা প্রথমত ক্যারেক্টার অ্যাসেসিনেট করে খুব খারাপভাবে। তখন বলতেছে, রাখেন এগুলো না। ও অনেকদিন এখানে থাকবে। হারুন স্যার ওর জন্য অনেক কিছু তৈরি করে রেখেছে।

ওই সময় আমার এক নম্বর কেসের পর দ্বিতীয় কেস এটা। এখানে কি হতে পারে। আমি মাকে বললাম, মা, একটা অথর্ব সন্তান আমি। জীবনে কিছুই করতে পারিনি মা-বাবা কারও জন্য। আমাকে মাফ করে দিও, আমার পক্ষে আর সম্ভব না। কারণ বৈদ্যুতিক শক থেকে শুরু করে আমার হাতের নখ ছোট কেন, এটার জন্য মারে। মাইরের কোনো ছুতা লাগে না। ওই দিন আনার পর ডিবি হারুনের বদলি হয়। মহান আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। ৯টার পর রিমান্ডে নেওয়া হয়, তার আগেই বিকেল ৫টায় তার বদলি হয়ে যায়। আমি তো চিন্তা করছিলাম যেটার ব্যাপারে শুনছি, এই রাতে আমার আর কিছু বাকি থাকবে না। ওরা আবার ইশারায় দেখিয়ে দিত (কী ধরনের নির্যাতন করা হবে) যে, আজকে এটা কালকে এটা। মুখ বেঁধে মুখে পানি দেয় আর পিটায়। এইগুলো উনারা যে কোথা থেকে ট্রেনিং নিয়েছেন। কাশ্মীরে যে ইন্ডিয়ান আর্মিরা পিটাই না? পরে আমি মিলিয়ে দেখেছি, ফরম্যাটটা একই। একই রকম। তো আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি। মানুষের দোয়াও বেশ কাজে দিয়েছে।

পাঁচ আগস্ট ওই সময় কারাগারের অবস্থা কি ছিল?

ওমর শরীফ মো. ইমরান (সানিয়াত): পাঁচ আগস্ট আমাকে বুঝাইতে ২ ঘণ্টা সময় লাগছে। আমি আর আসিফ কেরানীগঞ্জ কারাগারের শাপলার ৪-এর এ তে ছিলাম দুজন। ৩টার সময় আমাকে বলছে যে, শেখ হাসিনা পালাই গেছে, চলে গেছে। আমি সত্যি কথা বিলিভ করি নাই। আমি বললাম, খবরদার কেউ গেট খুলবেন না। ডা. ডোনার আঙ্কেলসহ বিএনপির সিনিয়র নেতারা এসে বকা দেয়। আমি বলেছি, আঙ্কেল তারপরও। উনারও আধা ঘণ্টা সময় লাগছে আমাকে বুঝাইতে। মানে আসলেই যে সে গেছে। ৫ তারিখের পরে জেলে অনেক হট্টগোল হয়। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় বের হয়ে ওইদিন আমার মা দুপুর থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরে বের হয়ে আম্মুকে প্রথম দেখি।

সবাই দোয়া করবেন, কিছু পারি বা না পারি অন্যায় বা খারাপ বা অন্য কোনো কিছু আমাদের দ্বারা যেন না হয়, চিন্তা যেন না আসে। আল্লাহ যেন ওই জিনিসটা রাখেন। কালবেলার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে আমি দোয়া চাচ্ছি।

সূত্র : কালবেলা

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।