সারাদেশ: রেমি (২৪) গেল কুরবানির ঈদে সারাটি দিন দাদীর বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি ঘুরেছিলেন। ভাই, বোন, স্বজনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথাও বলেছে। সন্ধ্যায় তার স্বামী পুঠিয়া থেকে চারঘাটের ভাড়া বাসায় তাকে রেখে আসে একা। সেই বাসায় রাতে সবার উদ্দেশ্যে ভিডিও বার্তা দিয়ে ভোর রাতে নিজেকে শেষ করে দেন। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মেয়েটির মৃত্যুর আগে দেয়া একটি দীর্ঘ ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তিনি তার জীবনের সব না বলা কথা, পারিবারিক সমস্যা ও সাংসারিক নানা বঞ্চনার কথা তুলে ধরেছেন। কী এমন হয়েছিল যে হাস্যজ্জ্বল ফুটফুটে তরুণী এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল? জানা গেছে, ১৭ জুন রাত ৯টায় এটি ছিল তার মোবাইলে রেকর্ড করা তৃতীয় ভিডিও। যেখানে স্বামী সাইম সাগর ও এক মাত্র কন্যাকে তিনি বারবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিদায় জানাচ্ছে। সেই সঙ্গে জানাচ্ছে যে বাবা মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় সমাজে, পরিবারে নানা কটু কথার শিকার হচ্ছেন তিনি। বাবা মায়ের দোষে সন্তান কখনও দোষী নয় এটি প্রমাণ করতেই নিজের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন মেয়েটি। তিন ভাগে মোট ৪২ মিনিটের ভিডিও সেদিন চারঘাটের ভাড়া বাসায় ধারণ করেন রেমি। এর পর ঠাণ্ডা মাথায় রাত তিনটার দিকে সেগুলো স্বামী সাইম সাগরকে পাঠান এবং ভোররাতে ভাড়া বাড়ির নিজ শয়ন কক্ষের বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন তিনি।
ভিডিওগুলো ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথম ২৪ মিনিটের ভিডিওতে তিনি নিজের পরিচয়, পারিবারিক পরিচয়, বাবা মায়ের দাম্পত্য কলহ আর নিজের প্রেমিক ও পরে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানিয়েছে। এখানেই বাবা মায়ের দাম্পত্য কলহের কারণে তার যে কিশোরী মনে অন্ধকার ছেয়ে গেছে তা উল্লেখ করেন রেমি। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে আশ্রয় চেয়েছিল প্রেমিক সাইম আক্তার সাগরের কাছে। যে সাগর তাকে পছন্দ করে বলে রাস্তা ঘাটে নানাভাবে উত্যক্ত করতেন। এক সময় অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সাগরকে বিয়ে করেন তিনি। পরে তাদের বাড়িতে বউ হয়ে উঠলে প্রেক্ষাপট বদলে যায়। যে মায়ের ভালোবাসা পাবে বলে শাশুড়ির কাছে এসেছিল সেটি ছিল ধুম্রজাল। এক রাতেই তা টের পান রিমি। ভিডিওতে রেমিকে বলতে দেখা যায়, পরের মা কখনও নিজের মা হয় না। এর পর নানা বঞ্চনার কথা, বাবার দ্বিতীয় বিয়ের ফলে মায়ের সঙ্গে দূরত্বের কথা এবং এ কারণে পরিবারে নিপীড়িত হবার বার বার বলেছেন তিনি। শুধু শ্বশুর বাড়ির সদস্যদের কারণেই যে নিপীড়িত হয়েছে তা নয়, মানসিক নির্যাতনের শিকার নিজের চাচি, বড় মার দ্বারাও হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রেমি। রেমির অভিযোগ তার চাচি তার বাবাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতে প্রলুব্ধ করে। পরে সেই আবার বাবা-মা খারাপ বলে খোঁটা দেয়। ছোট ছোট নানা অভিযোগ তুলে জীবনের শেষ সময়ে নিজের স্বীকারোক্তি দিয়ে যান রেমি।
পুঠিয়া উপজেলার গোন্ডগোহালি গ্রামের কেন্দ্রীয় মসজিদের ঠিক পাশেই আম গাছের ছায়ায় নীল পলিথিনে মোড়ানো বাঁশের বেড়ায় ঘেরা রেমির কবর। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সেখানে গিয়ে দেখা যায় কবরটির চারপাশে এখনও ফাঁকা রয়েছে। রেমি তার দ্বিতীয় ভিডিওতে তার মেয়েকে বলে গিয়েছে, যেখানে তার করব দেয়া হবে সেখানে যেন চারপাশে ফুলগাছ লাগানো হয়। সে খুব ফুল গাছ পছন্দ করতেন। কবরস্থান থেকে খানিক পশ্চিমে রেমিদের বাড়ি। সেখানে থাকেন তার ষাটোর্ধ দাদি রাহেলা বেগম। তিনি জানান, লেখাপড়ায় ভীষণ মেধাবী রেমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছেন গোল্ডেন এপ্লাস। পড়াশোনা করছিলেন রাজশাহী মহিলা কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞান চতুর্থ বর্ষে। ঈদের দিনও দাদির বাড়িতে গিয়ে ভালো মতো ছিলেন রেমি। কোনো কারণে এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে মেয়েটি বেশিরভাগ সময় মন খারাপ করে থাকতেন বলে জানান তিনি। মৃত্যুর আগে দেয়া স্বীকারোক্তিতে রেমি তার শ্বশুরবাড়ির মানসিক নির্যাতনের কথা অল্প বিস্তর বলে গেছেন ভিডিওতে। ছোট ভাই রাগিব ও তার বাবা আব্দুর রহিম সে অভিযোগ আরও পোক্ত করলেন। রাগিব বলছেন, রেমিকে দিয়ে বারংবার লাখ লাখ টাকা কিস্তি তুলেছেন তার শাশুড়ি। এ নিয়ে সংসারে অশান্তি হলে মারধরও করা হয়েছে তাকে। এ ছাড়া বাবা মায়ের কৃতকর্মের ফিরিস্তি তুলে নানা সময় তাকে খোঁটা দিত পরিবারটি। রাগিব জানান, বোন তাকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন। জীবনের সব ঘটনা মোটামুটি সবই বলতেন তাকে। রাগিবের মতে, স্বামী সাগর তার মায়ের কথা মতো রেমিকে মানসিক নির্যাতন করতেন। এমনকি ননদেরাও নির্যাতনের দিক থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। বয়সে ছোট ননদও নানা ছুতোয় মানসিক শাস্তি দিতো তাকে। ভিডিওতে ছোট ননদের পা ধরে মাফ চাওয়ার বিষয়টি সেটি নির্দেশ করে বলেও উল্লেখ করে রাগিব।
আর বাবা আব্দুর রহিম ভাড়া থাকেন পুঠিয়া সদরের থানার পাশে একটি বাড়িতে। বৃহস্পতিবার (২১ জুন) দুপুরে তাকে সেই বাড়িতে পাওয়া গেল। সঙ্গে ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। রেমির কথা জানতে চাইতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বাবা রহিম। কান্না জড়িত কণ্ঠে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, ২০১৪ সালে রেমিকে নানা ছল চাতুরী করে বয়স না হলেও জোর করে ভুয়া কোর্ট ম্যারেজ কাগজে বিয়ে করে নিয়ে যায় সাগর। পরে মেয়টি ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু তখন ফিরে আসার সব পথ বন্ধ। এ ছাড়া বাবার দ্বিতীয় সংসারের কারণে কিছুটা মনমালিন্য ও দূরত্ব ছিল বাবার সঙ্গেও। এই দূরত্বই হয়তো এখন ক্ষণে ক্ষণে পোড়াচ্ছে বাবা রহিমকে। ফেরত আসার সময়ে রহিম এ প্রতিবেদককে বলেন, রেমিকে মানসিকভাবে পাগল বানিয়েছে সাগর ও তার পরিবার, এ মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ী। বিয়ের পর কয়েক বছর আগেও রেমি তার শ্বশুর বাড়িতেই ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলে ফাঁস নিয়েছিল। সেবার বাড়ির চালা কেটে তাকে উদ্ধার করে পরিবারের সদস্যরা। প্রশ্ন রাখেন কখন একটি মেয়ে বারবার আত্মহত্যা করতে চায়? এ ঘটনায় বিচার চান তিনি। এদিকে সব অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা যাচাই করতে রেমির স্বামী সাইম সাগরের গ্রামের বাড়ি কাঁঠালবাড়িয়াতে গেলে ভেতর থেকে কেউ কথা বলতে রাজী হননি। জানানো হয় সাগর তার মেয়েকে নিয়ে রাজশাহীতে তার সাংবাদিক মামার বাড়িতে গেছেন। একই সময়ে সাইম সাগরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাবার পর তিনি কথা বলতে বলতে লাইন কেটে দেন। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রতিবেদককে ফোন করে ওখান থেকে চলে আসতে বলেন তার মামা। পরে বারংবার যোগাযোগের চেষ্টা করার পর রাজশাহীস্থ সাংবাদিক মামা সাইম সাগরের একটি সাক্ষাৎকার মোবাইলে রেকর্ড করে এ প্রতিবেদককে পাঠান। অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার সঙ্গে প্রতিবেদককে দেখা করতে দেননি। জানিয়েছেন, এ ঘটনায় মেয়ে ও বাবা শোকে মুহ্যমান, তাই দেখা করা সম্ভব নয়। মোবাইলে রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারে রেমির স্বামী সাইম আক্তার সাগর বলছেন, গত এক বছর থেকে রেমির মানসিক সমস্যা বেড়ে যায় ফলে রাজশাহীতে ডা. জসিম উদ্দিনের কাছে তার চিকিৎসা চলছিল। রেমির স্বজনরা শ্বশুর বাড়ির মানসিক নির্যাতনের যে অভিযোগ তুলেছেন তা মিথ্যা বলেও দাবি করেন সাগর। সাগর বলেন, যা বলার রেমি নিজে ভিডিওতে বলে গেছেন, সেখানে কাউকে তার এ মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. মজিবুল হক আজাদ খান একজন মনোবিজ্ঞানী। বহুদিন ধরে তিনি আত্মহত্যার কারণ ও তা প্রতিরোধে কাজ করছেন। তিনি বলছেন, ভঙ্গুর পরিবার, বাবা মায়ের সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিলে আস্থা হারাতে থাকে সন্তান। ভেঙে যাওয়া মনোবল ফিরে পেতে কোনো আস্থাভাজন কাউকে না পেয়ে পরিকল্পনা করে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে কিশোর, তরুণ তরুণীরা। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য দেখভাল করার ওপর জোর দিলেন তিনি। তার মতে, সমস্যায় জর্জরিত ব্যক্তি কোথাও তার কথা জানানোর সুযোগ পান না। কেউ তার কথা শুনতে চান না। তাই স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের একটি অংশ থাকা জরুরি, যেখানে শিক্ষার্থী তার সমস্যা নিয়ে কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। সেইসঙ্গে এমন ঘটনার পর যে থানায় ইউডি মামলা হয় সেটি সূক্ষ্ম তদন্ত করে পেছনের কারণ উৎঘাটন করাও জরুরি বলে মনে করেন এ গবেষক। এতে আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করে পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ ইন্ধনদাতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি আত্মহত্যা প্রবণতা কমাতে কাজ করা যাবে বলেও জানান তিনি। নিহত রহিমা আক্তার রেমির সাত বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। স্বজনরা জানায়, আট বছরের সংসার জীবনে পারিবারিক দাম্পত্য কলহের কারণে শালিস হয়েছে বহুবার। এরপরও ফিরতে চেয়েছেন স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু সে ফেরা আর হয়নি। ১৮ জুন চারঘাট থানায় রেমির বাবা মেয়ের মৃত্যুর কথা জানিয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। চারঘাট মডেল থানায় মামলা নম্বর ১৯। কিন্তু সেখানে কাউকে এ মৃত্যুর জন্য দায়ী করেননি তিনি। যে তির্যক মন্তব্যের জীবন থেকে পালিয়ে রেমি চেয়েছেন শান্তি, সেই শান্তি তিনি আদৌ পেয়েছেন কি না তা জানা যায়নি। তবে বলে গেছেন মৃত্যুর পর কি শাস্তি হবে তিনি জানেন না, জীবিত অবস্থায় যে শাস্তি পেয়েছেন তা পরকালের চেয়েও কঠিন।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |