প্রচ্ছদ অপরাধ ও বিচার মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে হ’ত্যা, কী ঘটেছিল সেদিন উঠে এল বর্ণনায়

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে হ’ত্যা, কী ঘটেছিল সেদিন উঠে এল বর্ণনায়

রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় ছুরি মেরে ক্ষতবিক্ষত করে হত্যা করা হয়েছে মা ও মেয়েকে। এ ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন এক নারী, যে ওই বাসায় মাত্র চার দিন আগে অস্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিল। নাম আয়েশা, গ্রামের বাড়ি রংপুরে, বাবা-মা আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ায় থাকে পাশেই জেনেভা ক্যাম্পে চাচা-চাচির সঙ্গে—এমন পরিচয় দেওয়া আনুমানিক ২০ বছর বয়সী ওই তরুণী গতকাল সোমবার সকালে কাজে এসেছিল বোরকা পরিহিত অবস্থায়, আর বেরিয়ে যায় স্কুলড্রেস পরে। তার কাঁধে ঝোলানো ছিল ব্যাগ। স্থায়ী গৃহকর্মী না হওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র বা তার সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কাগজপত্র রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন গৃহকর্তা।

ভবনটির একাধিক সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, নাফিসার বাবা স্কুলের উদ্দেশ্যে সকাল ৭টার দিকে বের হয়ে যান। সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বোরকা পরে ওই বাসার লিফটে ওঠে সাত তলায় যায় গৃহকর্মী আয়েশা। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ড্রেস পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে বের হয়ে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নাফিসার বাবা বাসায় ফিরে স্ত্রী ও মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান।

এই জোড়া হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততায় সন্দেহভাজন গৃহকর্মীর বাসায় প্রবেশ ও বেরিয়ে যাওয়ার মাঝের সময়টিতে মা ও মেয়ে খুন হয়েছেন বলে ধারণা পুলিশের। পরে খবর পেয়ে শাহজাহান রোডে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিপরীত পাশের আবাসিক ভবনের সপ্তম তলার ওই বাসা থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

নিহত লায়লা আফরোজের বয়স ৪৮ বছর। আর তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজের বয়স ১৫ বছর। নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, আর মা লায়লা আফরোজ ছিলেন গৃহিণী।

গৃহকর্তা এ জেড আজিজুল ইসলাম পেশায় শিক্ষক। তিনি উত্তরার সানবিমস স্কুলে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ান। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ওই বাসায় ১৩ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোরে।

প্রতিদিনের মতো গতকাল সকাল ৭টার দিকে স্কুলের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে যান আজিজুল। স্কুলে পরীক্ষা চলছে তাই বাসায় ফেরেন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেকটা তাড়াতাড়ি। বেলা ১১টার দিকে ফিরে বাসায় এসে তিনিই প্রথম মেয়েকে ড্রয়িং রুমে ও রান্নাঘরে স্ত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। পরে তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, খবর দেওয়া হয় পুলিশে।

ভবনের একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ বলছে, সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বোরখা পরিহিত অবস্থায় ওই বাসায় প্রবেশ করে মাত্র চার দিন আগে কাজে যোগ দেওয়া ‘আয়েশা’। আর ৯টা ৩৬ মিনিটে স্কুলড্রেস পরে নির্বিঘ্নে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। যে স্কুলড্রেস ছিল খুন হওয়া নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসার।

ওই বাসার টয়লেটে থাকা একটি বালতি থেকে দুটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করেছে পুলিশ। হত্যাকারী ঘটনার পর বাসার টয়লেটে ঢুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়—এমন আলামত পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত এই জোড়া খুনের ঘটনায় ওই গৃহকর্মীরই জড়িত থাকার বিষয়টি ধারণা করে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ‘ঘটনার আগে-পরে ওই বাসায় একজনের আসা-যাওয়াই দেখা গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে আমরা একজনই দেখেছি, পরে দেখব আশপাশে আরও কেউ ছিল কি না।’

ওই বাসাটিতে গিয়ে দেখা যায়, লিফটের সামনে থেকে বাসার দরজা পর্যন্ত ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দরজা খুলতেই আসবাবপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখা গেছে।

ভেতরের চিত্র প্রসঙ্গে পুলিশ বলছে, বাসায় ধস্তাধস্তির আলামত রয়েছে, মেঝেতে এবং দেয়ালে আছে রক্তের দাগ। আলমারি ও ভ্যানিটি ব্যাগ তছনছ অবস্থায় রয়েছে। এ থেকে তাদের ধারণা, বাসা থেকে কিছু খোয়া যেতে পারে। তবে কী কী খোয়া গেছে, তা জানাতে পারেনি পুলিশ। তবে গৃহকর্মী স্কুলড্রেস পরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার কাঁধে একটি ব্যাগ ছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘নিহত নাফিসাকে পাওয়া যায় ড্রয়িং রুমে। যেখানে গিয়ে দেখা গেছে, ইন্টারকমের রিসিভারটি নিচে পড়ে আছে। আর ইন্টারকমের কেবলটি ছেঁড়া। সেই থেকে ধারণা করা হচ্ছে, নিহত নাফিসা আহত হওয়ার পর ইন্টারকমে কল করতে চেয়েছিল। কিন্তু হত্যাকারী ইন্টারকমের কেবলটি ছিঁড়ে ফেলে।’

গৃহকর্তা আজিজুল ইসলাম জানান, বাসায় এসে প্রথমে দরজায় নক করে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে, দেখতে পান দরজা খোলা। প্রথমে তিনি প্রবেশ করে ড্রয়িং রুমে মেয়ে নাফিসার রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেন এবং পাশের রুমে একটু দূরে পড়ে ছিল স্ত্রীর রক্তাক্ত দেহ। বেঁচে থাকতে পারে—এমন ধারণা থেকে প্রতিবেশীদের সহায়তায় মেয়েকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন আজিজুল, যদিও সেখানে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আর পুলিশ এসে বাসা থেকে লায়লা আফরোজের লাশ উদ্ধার করে।

মরদেহ দুটির সুরতহালের পর ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুজনের শরীরেরই একাধিক স্থানে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন থাকার কথা বলেছে পুলিশ।

আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একজন কাজের মহিলার দরকার ছিল। সাধারণত বাসার গেটে অনেকেই কাজের সন্ধানে আসেন। আমরা দারোয়ানকে এমন কেউ এলে জানানোর কথা বলে রেখেছিলাম। চার দিন আগে একটি মেয়ে কাজের সন্ধানে আসে। বোরকা পরিহিত অবস্থায় ওই মেয়েটি এলে দারোয়ান তাকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এরপর আমার স্ত্রী মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে কাজে রেখে দেয়। পরে আমি স্ত্রীর মুখে শুনেছি, মেয়েটার নাম আয়েশা। আয়েশা জানায়, তাদের গ্রামের বাড়ি রংপুরে, জেনেভা ক্যাম্পে চাচা-চাচির সঙ্গে থাকে। বাবা-মা আগুনে পুড়ে মারা গেছে, তার শরীরেও আগুনে পোড়ার ক্ষত রয়েছে বলে জানায়। স্থায়ী গৃহকর্মী না হওয়ায় তার কোনো কাগজপত্র রাখা হয়নি।’

গৃহকর্তা আরও বলেন, ‘কাজ শুরুর পর প্রথম দুদিন সময়মতো এসেছে সে (আয়শা), গতকাল (রোববার) এসেছিল সাড়ে ৯টার দিকে। আজ (গতকাল) সকাল ৭টার পর যখন আসে, স্বাভাবিকভাবেই বাসার নিরাপত্তাকর্মী খালেক তাকে ভেতরে আসতে দেয়। কিন্তু বের হওয়ার সময় স্কুলড্রেস পরা এবং মুখে মাস্ক থাকায় গেটে দায়িত্বরত থাকা খালেক চিনতে পারেননি। তারপরও গেট থেকে বের হওয়ার পর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, সে সপ্তম তলার ৭-বি ফ্ল্যাটে থাকে বলে চলে যায়। সেটি আজিজুলেরই ফ্ল্যাটের নম্বর, সেখানেই গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছিল আয়েশা।’

আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর বাসার দারোয়ান খালেককে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তিনি জানিয়েছেন, চার দিন আগে বাসায় কাজের জন্য আসায় এক নারীকে আজিজুল ইসলামের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওই নারী তার পূর্বপরিচিত নন।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য পেয়েছি, সেসব যাচাই-বাছাই চলছে।’

গৃহকর্মীর প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নেরজবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা ঘটনার সঙ্গে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কাজ করছি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি, হত্যার আগে-পরে তার উপস্থিতি ও অ্যাকটিভিটিজ (কর্মকাণ্ড) বিশ্লেষণ করে পরবর্তী তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাব।’

সূত্র : কালবেলা