প্রচ্ছদ অপরাধ ও বিচার মৃদুভাষের আড়ালে দুর্নীতির কদর্য রূপ

মৃদুভাষের আড়ালে দুর্নীতির কদর্য রূপ

অপরাধ: স্বল্প কথায় প্রশ্নের জবাব দিতেন। বিতর্কিত খুব বেশি কোনো বক্তব্যও শোনা যায়নি তার কণ্ঠে। অনেকটা সজ্জন ভাবতেন সবাই। তিনি ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা যেখানে সবাই বিতর্কিত হয়েছেন, সেখানে দীর্ঘদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেও তিনি বিতর্কিত হয়নি। অথচ ভেতরে ছিল তার দুর্নীতির এক ভয়ংকর রূপ। সরকার পরিবর্তনের পর তার সেই কদর্য চেহারা বের হতে শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে তার পরিবারের সদস্যদের ৩২০ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। পাশাপাশি আরও ২০০ কোটি টাকার বেশি মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ মিলেছে।

এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আসাদুজ্জামান কামাল, তার স্ত্রী লুত্ফুল তাহমিনা খান, তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান, মেয়ে সোফিয়া তাসনিম খান ও সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেনকে আসামি করে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক। এ সপ্তাহেই তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, দুদকের অনুসন্ধানে কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে নামে-বেনামে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের প্রমাণ মিলেছে। যার মধ্যে ব্যাংকের নগদ অর্থ, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। তাদের ব্যাংক হিসাবেই শত কোটি টাকার বেশি অর্থের সন্ধান মিলেছে। এছাড়া তার এপিএস মনিরের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ মিলেছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুদক টিম ঐ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে অন্তত ২০০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। আপাতত এসব কারণেই মামলা সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্তে তাদের এর চেয়ে বহুগুণ সম্পদ ও মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা। এছাড়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের অন্য পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। এ যাত্রায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা না হলেও খুব শিগগিরই মামলার সুপারিশ কমিশনে দাখিল করা হবে।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পরিবারসহ ঐ পাঁচ জনের বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, ডিআইজি মোল্যা নজরুল ইসলাম, মন্ত্রীর সাবেক পিএস অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান আছে। ইতিমধ্যে কামালের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব ও আয়কর নথিসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঐ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে বস্তায় বস্তায় কোটি কোটি টাকা আদায় করার অভিযোগ ছিল। যার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আসাদুজ্জামান খান কামালের ধানমন্ডি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। তখন ঐ বাড়ির দোতলার একটি ছোট্ট কক্ষ থেকে চারটি কার্টনে থাকা ৪ কোটি টাকা লুট হয়ে যায়। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই টাকার কথা জানায়নি। এমনকি একটি অডিও বার্তায়ও তার কণ্ঠ শোনা গেছে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক জন কর্মকর্তা সালথায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার নির্দেশনাও দেন তাকে। তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন বলে অডিওতে শোনা যায়।

আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন সে কারণে আদালতের অনুমতিক্রমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তার স্ত্রী, দুই সন্তান এবং মন্ত্রীর পিএস, এপিএসসহ ঐ ১০ ব্যক্তিকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ আদেশ দেয় আদালত। আদালতে দেওয়া আবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অকল্পনীয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পালাতে পারেন মর্মে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। আদালত তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দেয়।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ঘুষ হিসেবে বস্তায় ভরে টাকা নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এই টাকা তিনি আদায় করতেন। এ জন্য তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের অন্য সদস্য ছিলেন যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাস।

অভিযোগ রয়েছে, জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিত এই চক্র। এই সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়নের ক্ষেত্রে ১ কোটি থেকে ৩ কোটি টাকা নিত এই সিন্ডিকেট। ২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্ল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্ল্যা নজরুল। পরবর্তী সময়ে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদের কাছে নগদ ২ কোটি টাকা দেন তিনি। এসময় পূর্বের চেকটি ফেরত নিয়ে মোল্ল্যা নজরুল ৩ কোটি টাকার একটি চেক দেন। পরে বাকি টাকাও দেওয়া হয়। এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের ফার্মগেটের বাসায়।

ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সে মোতাবেক তাদের নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। নিয়োগের জন্য জনপ্রতি ৮ লাখ-১২ লাখ টাকা নিত এই সিন্ডিকেট।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।