প্রচ্ছদ হেড লাইন মুখোশের আড়ালে ‘ভয়ংকর’ মিল্টন সমাদ্দারের চাঞ্চল্যকর তথ্য

মুখোশের আড়ালে ‘ভয়ংকর’ মিল্টন সমাদ্দারের চাঞ্চল্যকর তথ্য

হেড লাইন: অবশেষে আইনের জালে ধরা পড়লেন মানবিক মুখোশের আড়ালে নানা অপকর্মে জড়িত মিল্টন সমাদ্দার। রাজধানীর মিরপুর থেকে গত বুধবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর জোনাল টিম। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। আরও কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মিল্টনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমে জাল মৃত্যুসনদ দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এদিকে মিল্টন সমাদ্দারের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে মিরপুরের পাইকপাড়া এবং বরিশালের উজিরপুরের সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া বুধবার রাতেই রাজধানীতে আনন্দ মিছিল করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন। গ্রেপ্তারের পর থেকেই ভুক্তভোগীদের অনেকে মিল্টনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি জানিয়েছেন, ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের মিল্টনকে রিমান্ডে নিয়ে তার স্ত্রীকেও (মিতু হালদার) ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আর যদি কেউ তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে, তাহলে তাকেও গ্রেপ্তার করা হবে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সেগুলো তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। মিল্টন সমাদ্দারকে রিমান্ডে নেওয়ার পর তার যে অপকর্মগুলো রয়েছে, সব তদন্ত করে বের করা হবে।’ ডিএমপির গোয়েন্দাপ্রধান জানান, ‘লাশ দাফনের পর চিকিৎসা ও সিটি করপোরেশনের স্বাক্ষর ও সিল জাল করে মৃত্যুসনদ দিতেন মিল্টন সমাদ্দার। সেই সিলগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে।’ মিরপুর মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে করা মামলার মধ্যে একটির বাদী গোয়েন্দা পুলিশের মিরপুর জোনাল টিমের উপপরিদর্শক (এসআই) কামাল পাশা। এ মামলাটি করা হয়েছে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করার অপরাধে। এ ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি এবং আশ্রমের ভেতরে আটকে রেখে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধরের অভিযোগে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যুসনদ তৈরির অভিযোগে করা মামলায় তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক মোহাম্মদ কামাল হোসেন। শুনানি শেষে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

খ্রিষ্টানদের নিয়ন্ত্রক হতে চেয়েছিলেন মিল্টন:

জোর করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিল্টন সমাদ্দার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রক হতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই লক্ষ্যে মিল্টন সমাদ্দার, তার ভাই লিটন সমাদ্দার এবং আত্মীয়স্বজন মিলে একের পর এক গির্জার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে তারা প্রথমেই সুকৌশলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিল ও স্বাক্ষর জাল করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিল্টন সমাদ্দার প্রথমে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র জাল করে নিজে গির্জা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এরপর সেই কমিটির অনুলিপি পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে। এরপর দলবল নিয়ে গিয়ে চার্চের ভেতরে থাকা যাজকদের বের করে দিয়ে দখল করে নিয়ে নেন। এ প্রক্রিয়ার প্রথমে মিল্টনরা দখলে নেন রাজধানীর গ্রিন রোডের ফেলোশিপ চার্চ। এই চার্চের কমিটিতে মিল্টন সমাদ্দারের বড় ভাই লিটন সমাদ্দার রয়েছেন। ফেলোশিপ চার্চের সম্পাদক প্রফেসর সরা বৈদ্য কালবেলাকে বলেন, ‘মিল্টন গংরা পথভ্রষ্ট। ওরা আমাদের মারধর করে জোর করে চার্চ থেকে বের করে দিয়ে দখলে নিয়েছে। যাজকরা চার্চ তালাবদ্ধ করে বসেছিলেন। ওরা ১৪টি তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেছে। মারতে মারতে যাজকদের চার্চ থেকে বের করে দিয়েছেন। আমরা পুলিশে অভিযোগ দিলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’ যোবেল হালদার নামের যাজকদের এক সহকারী কালবেলাকে বলেন, ‘মিল্টনের বড় ভাই ও তাদের লোকজন আমাকে মারতে মারতে দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে নামিয়েছে। আমাকে বেধড়ক মেরেছে তারা। বিশৃঙ্খলা তৈরি করে তারা চার্চের দখল নিয়েছে। ৫ তলা ভবন থাকার পরেও এখন আমরা মিরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে প্রার্থনাস্থল বানিয়েছি।’বরিশালে একই কায়দায় খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রধান গির্জা চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চ দখলের চেষ্টা করেছেন মিল্টন সমাদ্দার। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষর জাল করে তৈরি করা এই চার্চের কমিটির সভাপতি মিল্টন সমাদ্দার নিজেই। সাধারণ সম্পাদক মিল্টন সমাদ্দারের বড় ভাই লিটন সমাদ্দার। এ ছাড়াও এই কমিটির সবাই মিল্টন সমাদ্দারের আত্মীয়। বিষয়টি নিয়ে যাজকদের সন্দেহে হলে তারা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। পরে মন্ত্রণালয় থেকে তাদের লিখিতভাবে জানানো হয়, মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়নি। বাংলাদেশের খ্রিষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের জ্যেষ্ঠ যাজক প্রেমানন্দ সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘মিল্টন সমাদ্দাররা দেশের সব চার্চ দখল করে খ্রিষ্টীয় সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রক হতে চেয়েছিলেন। তিনি পথভ্রষ্ট হয়ে যাজকদের মারধর করে তাদের বের করে দিয়ে আমাদের পান্থপথের চার্চ দখল করে নিয়েছেন। এ কায়দায় তিনি বরিশালের চার্চও দখল করতে চেয়েছিলেন। আমাদের যাজকদের বেধড়ক মারধর করেছে তাদের লোকজন। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:

মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, তিনি মিডিয়ায় ৯০০ মরদেহ দাফনের দাবি করলেও অনুসন্ধানে মাত্র ৬৫টি মরদেহ দাফনের তথ্য মিলেছে। বাকি মরদেহ তিনি ঘুষ দিয়ে গোপনে দাফন করার দাবি করলেও সে দাবির কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। কারণ ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’র প্যাডে ইস্যু করা ডেথ সার্টিফিকেটেই বৈধভাবে মরদেহ দাফনের প্রমাণ রয়েছে কালবেলার হাতে। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি, হাসপাতালের অনুমোদন না থাকার পরও আশ্রমের ভেতরে অপারেশন থিয়েটার স্থাপন এবং নিজেই অপারেশন করা, হাসপাতালে চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করা, ডাক্তারের সিল ও স্বাক্ষর জাল করে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি, টর্চার সেলে মানুষকে মারধর, গভীর রাতে মরদেহ দাফন, দাফনের ক্ষেত্রে কোনো আইনকানুন না মানা, এমনকি বিষয়টি কাছের থানা পুলিশকে অবহিত না করা, নামসর্বস্ব মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি থেকে মাসে ৬-৭ লাখ টাকার ভিত্তিহীন আয় দেখানো, আশ্রমের ভেতরে বসে মাদক সেবন করে বয়স্কদের মারধরসহ অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার আশ্রমে মারধরের শিকার হওয়ার কয়েক দিন পর মারা যান একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে তার আশ্রমে ৩শর বেশি অসহায় মানুষ থাকেন বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে সব মিলিয়ে একশজনও নেই। এসব অপকর্ম করতে তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করতেন। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম বলেও তিনি স্থানীয় সাধারণ মানুষকে হুমকি-ধমকি দিয়েছেন।

মিল্টনের গ্রেপ্তারে এলাকাজুড়ে উচ্ছ্বাস, আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ:

এদিকে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের পর পরই তার জন্মস্থান বরিশালের উজিরপুর এবং বর্তমান আবাসস্থল কল্যাণপুর এবং পাইকপাড়ার সাধারণ মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। রাতেই বরিশালে মিষ্টি বিতরণ করে উল্লাস প্রকাশ করেন অনেকে। এ ছাড়া মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেপ্তারের পর পরই পাইকপাড়ার সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নেমে এসে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানান, তারা এতদিন ভয়ে মুখ খুলতে পারেননি। কেউ মুখ খুললেই তাকে মিথ্যে মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতো। এ ছাড়াও আশ্রমের ভেতরে আটকে বেধড়ক মারধর করে পরে চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে দিত। এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার কালবেলাকে বলেন, ‘মিল্টন সমাদ্দার ও ওল্ড অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা ভয়াবহ। এখানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের দায়িত্ব ছিল শুরু থেকে সংস্থাটিকে সুপারভাইজ করা; কিন্তু সেটা সমাজ সেবা অধিদপ্তর করেননি। মিল্টন সমাদ্দার গ্রেপ্তার হয়েছে; কিন্তু এখন ওল্ড অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ারের যারা আছেন, তাদের দেখাশোনা, খাবার, চিকিৎসা ও অন্যান্য মানবিক বিষয় রাষ্ট্রকে দেখতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। ওই আশ্রমের শিশুসহ বৃদ্ধ যে কজনই আছে, তারা কী খাচ্ছে না খাচ্ছে, কেমন আছে। তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাজ।’ জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন। আমরা আইন অনুযায়ী তদন্ত করার জন্য বলেছি। যদি তদন্ত করার পর নিবন্ধন বাতিল পর্যায়ে যায়, তা হলে তারা সুপারিশ করবে। আমরা মন্ত্রণালয়কে বলব নিবন্ধন বাতিল করার জন্য। আমরা নিবন্ধনকারী অথরিটি। আমরা মেডিকেল বা অন্য কোনো বিষয়ে বলতে পারব না।’

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।