
যার হাতে সিটি করপোরেশন এলাকা, মূলত তার নিয়ন্ত্রণেই থাকে কুমিল্লার রাজনীতি। এ ধারা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, সেই পৌরসভার কাল থেকে। তাই কুমিল্লা-৬ (সদর) সংসদীয় আসনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এমন বাস্তবতায় দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে নানা দিক বিবেচনায় নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। একই সঙ্গে এখানকার আগামীর রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতিও নির্ধারণ করতে হয়েছে দলকে।
স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভোটের মাঠে সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু বড় ‘ফ্যাক্টর’, এ আসনের সাবেক পাঁচবারের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী লে. কর্নেল আকবর হোসেনের মৃত্যুর পর থেকেই। কর্নেল আকবরের ফুফাতো ভাই সাক্কু। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলেও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবসময়ই সাক্কুকে নিয়ে হিমশিম খেয়েছে সরকারে থাকা দাপুটে আওয়ামী লীগও। শেষবার তো অনেকটা জোর করেই তার বিজয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও মুখে মুখে উচ্চারণ হতো সাক্কু ‘পপুলার পাবলিক লিডার’।
সেই থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন, ভোট এলেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন সাক্কু। এবারও তাই হয়েছে। কিন্তু বাধ সেজেছে তার দলীয় বহিষ্কারাদেশ। ২০২২ সালে সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো দল থেকে বহিষ্কৃত হন। তাই বিকল্প খোঁজা শুরু করে দল।
এদিকে বারবার আসন পুনর্বিন্যাসে প্রায় গৃহহীন হয়ে পড়া পাশের সদর দক্ষিণ উপজেলার বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা মনিরুল হক চৌধুরী যোগ্য বিকল্প হয়ে ওঠেন। সাক্কু নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। না হয় মনির চৌধুরীকে দিলে তিনি পাস করিয়ে আনার দায়িত্ব নেন। এতেই ভাগ্য খুলে যায় মনিরুল হক চৌধুরীর। দল এদিকেই এগোতে থাকে। এ সিদ্ধান্তে দলের সাংগঠনিক ও ভবিষ্যত নেতৃত্ব ধারায়ও পরিবর্তন আসবে।
দল বিবেচনায় নেয় ব্যক্তি ভোট। যেখানে এগিয়ে আছেন মনিরুল হক সাক্কু। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করলে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছে দল। আবার সদর দক্ষিণ উপজেলা নতুন করে সদর আসনে যুক্ত হওয়ায় মনিরুল হক চৌধুরীরও কিছু ব্যক্তি ভোট রয়েছে। তিনিও ওই আসনের জননেতা, সাবেক এমপি ও হুইপ ছিলেন।
এদিকে এ আসনে ছিটকে পড়া অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা আমিন উর রশিদ ইয়াছিনও কুমিল্লা সদর দক্ষিণেই বিএনপির রাজনীতি শুরু করেন। মনিরুল হক চৌধুরী এবং আমিন উর রশিদ ইয়াছিন তখন থেকেই একজন আরেকজনের প্রতিপক্ষ। আকবর হোসেনের মৃত্যুর পর আমিন উর রশিদ সেখান থেকে সরে এসে সদর আসনে রাজনীতি শুরু করেন। তিনি একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তা। তিনি দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় তার সমর্থকরা কয়েকদিন ধরেই নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন। বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ, আওয়ামী লীগ আমলে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের স্ত্রী-কন্যাদের দিয়ে সংবাদ সম্মেলন, কিছুই বাদ যায়নি। সোমবারও তার মনোনয়ন দাবিতে মিছিল ও সমাবেশ করেছেন কুমিল্লার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এদিন বিকেলে ‘জেন-জেড-৩৫০০’ নামের সংগঠনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা কুমিল্লা জিলা স্কুলের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আমিন উর রশিদ ইয়াছিন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও আহ্বায়ক ছিলেন। দলকে সাংগঠনিকভাবে সংগঠিত না করা, আওয়ামীবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে না থাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি দলের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েন। ৫ আগস্টের পর দল তাকে পদ থেকে সরিয়ে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করে। অভিযোগ রয়েছে, তার শ্যালক নিজামুদ্দিন কায়সার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনিরুল হক সাক্কুকে ফেল করাতে দুই দফা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এনিয়ে ইয়াছিন-সাক্কু দ্বন্দ্ব চরম আকার নেয়।
মনোনয়ন পাওয়া মনিরুল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ইয়াছিনসহ সবার সঙ্গে দেখা করব। সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব। আমি কুমিল্লায় রাজনীতি করি।’
সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু কালবেলাকে বলেন, তিনি জীবনের শুরু থেকেই গত ৪৭ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করছেন। দল ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তাদের পরিবারই কুমিল্লায় বিএনপির রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। কখনো দল ছেড়ে যাননি।
সাক্কু বলেন, ‘মেয়র নির্বাচন করায় দল আমাকে বহিষ্কার করে। প্রথমবারের বহিষ্কারাদেশ মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর খালেদা জিয়া প্রত্যাহার করে নেন। দ্বিতীয়বার বহিষ্কারের পরও অনুসারীদের নিয়ে দলীয় সব কর্মসূচি পালন করে আসছি।’
সাক্কু আশা প্রকাশ করেন, দল এখন তার বহিষ্কার তুলে নেবে। মনিরুল হক চৌধুরীকে বিজয়ী করে তারেক জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে সবকিছু করবেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে আমিন উর রশিদ ইয়াছিন সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের শান্ত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটি প্রাথমিক মনোনয়ন।
কুমিল্লা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম সংগঠক শাহ মো. সেলিম কালবেলাকে বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক স্বচ্ছ গতিধারায় বিশ্বাসী। মনিরুল হক চৌধুরীকে এবার মূল্যায়ন করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এভাবে সবাইকে একে একে মূল্যায়ন করলে কুমিল্লা বিএনপি তার অতীতের সমৃদ্ধ ধারায় ফিরে আসবে।’
কুমিল্লা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া জানান, তিনি নিজেও প্রার্থী ছিলেন। ধানের শীষ বড় কথা। যাকে দেওয়া হয়েছে, দল ঐক্যবদ্ধ। তিনি দল ও সবার প্রার্থী।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান মাহমুদ বলেন, আমরা দল করি। দলের সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। একাধিক প্রার্থী বিএনপির মতো বড় দলে থাকা স্বাভাবিক। দলীয় মনোনয়ন একটা দলগত সিদ্ধান্ত। দলীয় আনুগত্য আছে বলেই আমরা নেতাকর্মী।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক উদবাতুল বারী আবু বলেন, ধানের শীষ যিনি পেয়েছেন তিনিই আমাদের প্রার্থী। সবাই মিলে ধানের শীষকে বিজয়ী করানো আমাদের দায়িত্ব।
সূত্র: কালবেলা













































