প্রচ্ছদ জাতীয় বেনজীরের তিন ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রকাশ্যে

বেনজীরের তিন ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রকাশ্যে

সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদ এবং বিদেশে অর্থপাচার পরিচালনায় নিযুক্ত ছিলেন একাধিক ব্যক্তি। তারা দেশে-বিদেশে বেনজীরের জন্য জমি বা সম্পদ কেনা, ব্যবসায়ীদের প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে নির্যাতনের মতো অপকর্ম সামাল দিতেন। আর বেনজীর আহমেদ নেপথ্যে থেকে এই সিন্ডিকেট সামনে রেখে নিয়ন্ত্রণ করতেন পুলিশের বিভিন্ন প্রকল্পের ব্র্যান্ডিং, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। এই দলের অগ্রভাগে ছিলেন এজিএম সাব্বির ওরফে বিকাশ সাব্বির, নাজমুস সাকিব জুবায়ের ও আমজাদ হোসেন আরজু।

জানা গেছে, তারাও বেনজীরের মতো দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। তাদের সঙ্গে বেনজীরের স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গে অংশীদারি ব্যবসাও রয়েছে। তবে বেনজীরকে নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর এক সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এই সহযোগীরাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

কে এই বিকাশ সাব্বির:
জানা গেছে, বেনজীর আহমেদের ক্যাশিয়ার হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন বিকাশ সাব্বির। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সাব্বির বড় হন রাজধানীর পূর্ব গোড়ানে। শিক্ষাজীবন শেষ করে ২০০২ সালে মাস্টারমাইন্ড স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে এক নারী শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয়ের পর তাকে বিয়ে করেন সাব্বির। ওই নারী শিক্ষকের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাজ্যের নাগরিক হওয়ায় সাব্বিরও যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। সেখানে নাগরিকত্ব লাভের পর তিনি ঐ স্ত্রীকে ত্যাগ করে এক বিমানবালাকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর একটি ছেলে এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর দুই সন্তান রয়েছে।

মাস্টারমাইন্ড স্কুলে শিক্ষকতার সময় সাব্বির বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ছেলেকে প্রাইভেট পড়ানোর সুবাদে মির্জা আব্বাস ও তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাসের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেই সূত্রে তিনি বিএনপির শীর্ষ ও মাঝারি মানের অনেক নেতার সঙ্গে গড়ে তোলেন সখ্য। তাছাড়া ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হাবিবুর রশীদ হাবীব তার বাল্যবন্ধু হওয়ার কারণে বিএনপির অনেক নেতার সঙ্গে এখনো তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা সমাবেশ ঘিরে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আটক হন বিকাশ সাব্বির। ঐ সময় সাব্বিরের গতিবিধি গোয়েন্দা বিভাগের নজরে এলে তাকে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বনানী থেকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে। তখন বেনজীর আহমেদের জোরালো সুপারিশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বেনজীরের ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় লন্ডনে:
লন্ডনে সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয় হয় বেনজীর আহমেদের ছোট ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তসলিম আহমেদ মুন্নার। সেই সূত্রে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে সম্পর্ক হয় বেনজীর আহমেদের সঙ্গে। এর পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাব্বির। আমজাদ হোসেন আরজু ও নাজমুস সাকিব জুবায়েরের সঙ্গে গড়ে তোলেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। ক্যাসিনোকাণ্ডে আটক মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার মাধ্যমে সাব্বির ওরফে বিকাশ বেনজীর আহমেদের ক্যাসিনোর মাসিক চাঁদার টাকা সংগ্রহ করতেন। পরবর্তী সময়ে বেনজীর আহমেদের তোড়জোড়ে সাব্বির মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক ও ক্রিকেট কমিটির প্রধান নির্বাচিত হন।

এরই মধ্যেই বেনজীর আহমেদের পরিবারের ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে ওঠেন এজিএম সাব্বির, নাজমুস সাকিব জুবায়ের ও আমজাদ হোসেন আরজু। এই তিনজনের সঙ্গে একাধিকবার থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পর্তুগালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে গেছেন বেনজীর আহমেদ। সাব্বির ও আরজুর মাধ্যমে মালদ্বীপ, দুবাই, লন্ডন এবং কানাডায় বাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন বলে সাব্বিরের ঘনিষ্ঠজনদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশে অর্থপাচারের কাজটিও এই দুজনের মাধ্যমেই হতো। কানাডায় আরজুর স্ত্রী ও সন্তান যে বাড়িটিতে থাকেন, জনশ্রুতি রয়েছে সেই বাড়িটিও বেনজীর আহমেদের টাকায় কেনা।

সাব্বির-আরজু ও জুবায়েরর যত সম্পদ:
দেশে নামে-বেনামে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক সাব্বির ও তার অন্যতম সহযোগী বেসরকারি টিভি চ্যানেলের (চ্যানেল ওয়ান) সাবেক বিপণন কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন আরজু ও নাজমুস সাকিব জুবায়ের। এর মধ্যে একটি শিশির বিন্দু, রাহিল’স মিডিয়া লিমিটেড, এলবি লিমিটেড, কানেকশিয়া লিমিটেড, সেন্টার ফর রিনিওয়েবল এনার্জি সার্ভিস লিমিটেড, বেনটেক, এলকো কেবল লিমিটেড, এইএক্সএ পাওয়ার লিমিটেড, মেইনস্কোয়ার ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, রিচমন্ড ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, স্টিলথ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বিটিএল ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিটি কম্পানিতে এজিএম সাব্বির, আমজাদ হোসেন আরজু ও নাজমুস সাকিব জুবায়েরের বিপুল পরিমাণ শেয়ার আছে। দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলেও মালিকানা রয়েছে সাব্বির ও আরজুর। গুলশান আবাসিক এলাকার সিইসি (জি) ব্লকের ১৩৪ নম্বর (পুরাতন ১৩০ নম্বর) প্লটের ১২ কাঠা ১২ ছটাক জমির উপর দুটি বেইসমেন্টসহ নির্মিত রেনকন আইকন টাওয়ারে দুই হাজার ২৪২ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট রয়েছে সাব্বিরের। এছাড়া ঢাকার গোড়ানে ১০ কাঠার প্লট, সাভার ফ্যান্টাসি কিংডমের পেছনে প্রায় ৬৬টি ঘরবিশিষ্ট বিশাল জমি। উত্তরা, গুলশান ও বনানীতে আছে একাধিক ফ্ল্যাট। লন্ডনে বিশাল বাড়ি ও দামি ব্র্যান্ডের একাধিক গাড়ি রয়েছে তার। দুবাইয়ে ফ্ল্যাট আছে বলেও গুঞ্জন আছে। বেনজীরের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে অংশীদারি ব্যবসা পরিচালনা করছেন সাব্বির। মেসার্স একটি শিশির বিন্দু নামে একটি প্রকাশনা সংস্থায় তাদের সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে।

বেনজীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ আরেকটি কম্পানি গঠন করেন সাব্বির। স্টিলথ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের কম্পানিটির ট্রেড লাইসেন্স ও আরজেএসসি রেজিস্ট্রেশেন নাম্বার যথাক্রমে ০৮৫৬৮৪ ও সি-১৫০৪১৯। এই কম্পানির মালিকানায় রয়েছেন বেনজীর পরিবারের সদস্যরাও। এছাড়া এসটি পিটারস স্কুল অব লন্ডন লিমিটেডের মালিকানায় আছেন সাব্বির। এই কম্পানিটিতেও বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা ও তার মেয়েদের বিনিয়োগ রয়েছে। গত ২৮ মে এই তিনটি কম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধের নির্দেশ দেন আদালত।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ করত রাহিল’স মিডিয়া লিমিটেড। এই কম্পানিকে কাজ দিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতেন বেনজীর আহমেদ। কম্পানিটির মালিকানায় বেনজীর আহমেদের পরিবারের কোনো সদস্যের নাম না থাকলেও প্রতি মাসেই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা পেতেন তিনি।

অন্য ব্যবসায়ীরা টাকা চাইলেই দেওয়া হতো হত্যার হুমকি:
এসটিআর এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সাদেক চৌধুরী বলেন, “২০১৮ ও ২০১৯ সালে সাব্বিরের কুড়িগ্রামের মিনি গ্রিড সোলার প্রজেক্টে প্রায় দুই কোটি টাকার মালামাল সরবরাহ করি। এই প্রজেক্টের ৫ শতাংশ শেয়ারহোল্ডার হিসেবে বিনিয়োগ করি। সেখানেও আরো ৫৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। বিনিয়োগের পর তারা বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দেয়নি। এমনকি লভ্যাংশও দেয়নি। এমনকি টাকা উদ্ধারে গেলে তারা আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়। আরজু এখনো নিয়মিত হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। ২০২১ সালের ৪ আগস্ট সকাল ৭টায় সাদা পোশাকে ছয় থেকে সাতজনের একটি দল আমাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তারা আমার পকেট থেকে স্বাক্ষরিত চেকের পাতা নিয়ে যায়। তারা এ সময় সাদা কাগজে মুচলেকা নেয়, আর কখনো সাব্বিরের কাছে যেন টাকা ফেরত না চাই। ওই সময় তারা বলে, ‘তুই জানস না সাব্বির স্যারের লোক।’ এখনো সাব্বির ও আরজুরা পুলিশের উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে আমাকে হুমকি দেয়।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমজাদ হোসেন আরজু ও বিকাশ সাব্বিরের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আমি প্রায় ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু তারা সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ক্ষমতা দেখিয়ে টাকা ফেরত দিতে টালবাহান করেন। একাধিকবার হুমকি দেন।’

এসব বিষয়ে জানতে এজিএম সাব্বির ও আমজাদ হোসেন আরজুকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।