প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক বিশ্ববাজারে স্বর্ণের বড় দরপতন, দেশে কমবে কবে?

বিশ্ববাজারে স্বর্ণের বড় দরপতন, দেশে কমবে কবে?

প্রাচীনকাল থেকে স্বর্ণ মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে তার অপরূপ ঔজ্জ্বল্য, মূল্য এবং স্থায়িত্ব দিয়ে। এটি শুধু একখণ্ড ধাতু নয়, বরং এক অনন্ত ঐশ্বর্যের প্রতীক। বছরের পর বছর ধরে স্থিতিশীল ও নিরাপদ বিনিয়োগের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত স্বর্ণের দাম টানা দুই দিন দরপতনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। খবর বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও খালিজ টাইমস

বৃহস্পতিবার (১৫ মে) এক মাসেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে মূল্যবান ধাতুটি। বিশেষ করে দুই বৃহত্তম অর্থনীতি- যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হওয়ায় সুরক্ষা সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা হঠাৎ করে কমে গেছে। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সুদের হারের দিকনির্দেশনা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এখন অপেক্ষায় রয়েছে-ফেড কী বার্তা দেয়।

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টায় বিশ্ববাজারে স্পট গোল্ড ০.৮ শতাংশ কমে প্রতি আউন্সে ৩ হাজার ১৫৪.১৬ ডলারে নেমে আসে, যা গত ১০ এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ড ফিউচারস ১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৫৭.৩০ ডলারে।

স্বতন্ত্র বিশ্লেষক রস নরম্যান জানান, ‘বর্তমানে বাজারে বিয়াররা (মূল্যপতনে লাভবান বিনিয়োগকারীরা) সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি বোঝা যাচ্ছে যে স্বর্ণের বাজার সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত কেনাবেচার মধ্যে ছিল এবং এখন সেটিরই প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।’

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এই সপ্তাহে একে অপরের উপর আরোপিত কিছু শুল্ক হ্রাসে সম্মত হয়েছে এবং ৯০ দিনের জন্য একটি বাণিজ্য বিরতি ঘোষণা করেছে। যদিও এই পদক্ষেপ বিশ্ববাজারে সাময়িক স্বস্তি এনে দিয়েছে, তবু বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই গেছে ৯০ দিনের পর কী হবে?

এর আগেই, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে স্বর্ণের দাম পৌঁছেছিল সর্বকালের রেকর্ড উচ্চতা- প্রতি আউন্সে ৩ হাজার ৫০০.০৫ ডলার। তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন, বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধের আশঙ্কা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণ ক্রয় এবং শক্তিশালী বিনিয়োগ চাহিদা মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল।

এদিকে বৈশ্বিক বাজারে স্বর্ণের দরপতনের প্রতিক্রিয়া পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বর্ণবাজার দুবাইয়েও। গত ২৪ ঘণ্টায় দুবাইয়ের স্বর্ণের দাম প্রতি গ্রামে প্রায় ১০ দিরহাম কমেছে।

দুবাই জুয়েলারি গ্রুপ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ প্রতি গ্রাম বিক্রি হয়েছে ৩৭৮.৫ দিরহামে, যা আগের দিনের তুলনায় ৯.৫৫ দিরহাম কম। ২২ ক্যারেট ৩৫০.৫, ২১ ক্যারেট ৩৩৬.৫ এবং ১৮ ক্যারেট স্বর্ণ বিক্রি হয়েছে ২৮৮ দিরহামে।

গোল্ডসিলভার সেন্ট্রালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রায়ান ল্যান সতর্ক করে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম ৩ হাজার ১৫০ ডলারে নামতে পারে। তবে যদি এ স্তরেও দাম স্থিতিশীল না থাকে, তাহলে সেটি আরও নিচে নেমে ৩ হাজার ১০০ ডলার পর্যন্ত যেতে পারে।

বিনিয়োগকারীদের চোখ এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সূচকের দিকে। বৃহস্পতিবারই প্রকাশিত হবে প্রযোজক মূল্য সূচক (পিপিআই), যা মূল্যস্ফীতির অবস্থা স্পষ্ট করবে। এর আগে প্রকাশিত ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) প্রত্যাশার তুলনায় দুর্বল এসেছিল, যা ফেডারেল রিজার্ভের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে।

পরে আজ ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের ভাষণও বাজারের দিক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, ফেড চলতি বছর ৫০ বেসিস পয়েন্ট সুদের হার কমাতে পারে এবং তা শুরু হতে পারে অক্টোবর থেকে।

সুদের হার কমলে সাধারণত স্বর্ণের বাজার উপকৃত হয়, কারণ স্বর্ণ সরাসরি কোনো সুদ না দিলেও তা কম সুদের হারের সময় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের নাশকতার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ

স্বর্ণের পাশাপাশি অন্যান্য মূল্যবান ধাতুও হারাচ্ছে তাদের দ্যুতি। স্পট সিলভার ১ শতাংশ কমে প্রতি আউন্সে ৩১.৮৯ ডলারে এসেছে, প্যালাডিয়াম ০.২ শতাংশ কমে ৯৪৯.০৭ এবং প্ল্যাটিনাম রয়েছে ৯৭৬ ডলারে।

এদিকে জনসন ম্যাথির এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্যালাডিয়ামের বাজার, যা ২০১২ সাল থেকে ঘাটতিতে ছিল, এবার ভারসাম্য ফিরে পেতে পারে। কারণ, পেট্রোলচালিত যানবাহনের উৎপাদন কমে যাওয়ায় (যেখানে এটি ব্যবহৃত হয়) এর চাহিদা প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং চীনে পুনঃচক্রায়নের হার বাড়বে।

বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বর্ণবাজার এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে বাণিজ্য উত্তেজনার সাময়িক প্রশমন, অন্যদিকে সুদের হার নিয়ে অনিশ্চয়তা, আবার মূল্যস্ফীতির গতিপথ ও রাজনৈতিক দোলাচল, সব মিলিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখন অত্যন্ত সতর্ক।

এদিকে দেশের বাজারে সর্বশেষ মঙ্গলবার (১৩ মে) স্বর্ণের দামে সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। তখন বিশ্ববাজারে ধাতুটির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বাজারেও দাম বৃদ্ধি পায়।

নতুন দাম অনুযায়ী, দেশের বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ৫৬৬ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৬৯ হাজার ১৮৬ টাকা। ২১ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ৫০৫ টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ২৮৩ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম এক লাখ ৩৮ হাজার ৪২৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম এক হাজার ৯৭ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৪৩৬ টাকা।

এর আগে সোমবার (১২ মে) দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম কিছুটা কমানো হয়। সবচেয়ে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ৩ হাজার ১৩৮ টাকা কমিয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৩ টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমেছে। এর প্রভাবে দেশের বাজারেও স্বর্ণের দাম সমন্বয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সহ-সভাপতি মাসুদুর রহমান।

চ্যানেল ২৪ অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে যখন স্বর্ণের দামের সমন্বয় হয়-তা বাড়ুক বা কমুক, তখন রাজধানীর তাঁতীবাজার বুলিয়ন মার্কেট সেই দামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমন্বয় করে। এরপর আমরা বাজুস থেকে সেই দাম প্রকাশ করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশের বাজারেও মূল্য সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এখনও একটি ম্যানুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, যার কারণে দাম সমন্বয়ের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লাগে।’

মাসুদুর রহমান বলেন, তাঁতীবাজার বুলিয়ন মার্কেট থেকে দামের সমন্বয় হওয়ার পর বাজুস থেকে দ্রুততম সময়ে তা প্রকাশ করা হবে।