সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার, সাবেক জেনারেল আজিজ, আইজি বেনজীর, ফুটবলের সালাম মুর্শেদী ভিন্ন ভিন্ন। তাদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। কিন্তু, ক্ষমতায় অনন্য। ইহজনমে লোভনীয় বা ঈর্ষা করার মতো সেলিব্রিটি তারা। কুয়েতের কারাগারে কয়েদ খাটা লাল পাসপোর্টের মাননীয় সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলও সেলিব্রিটি। তাকে দিয়েই বিদেশি কারাগারে বাংলাদেশের কোনো মাননীয়র বিদেশের কারাগারে অভিষেক। আর বিদেশে বীভৎস লাশ হওয়ার রেকর্ড এমপি আনারকে দিয়ে। তাও আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী নিরাপদ দেশ ভারতে। জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সাবেক আইজিপি বেনজীরের সম্পদ বাজেয়াপ্তের নির্দেশ, সালাম মুর্শেদীসহ ফুটবল ফেডারেশনের কয়েকজনকে ফিফার জরিমানা আর সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুন একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক নেই। তবে, সাম্প্রতিক ঘটনার সিরিজ।
আনারের ঘটনাটি মৃত্যু পর্যন্ত গড়িয়ে যাওয়ায় এখন কিচ্ছার ঝাঁজ চরমে। এ ঝাঁজের তোড়ে মানুষকে ঠিকঠাক মতো ইন্নালিল্লাহ পড়ার সময়ও দেওয়া হচ্ছে না। ঠাকুরমার ঝুলি বা আরব্য রজনীর মতো কিচ্ছার ঝড় বইয়ে দেওয়া হয়েছে। যার কোনো কোনো অংশ এই তো বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ঝড় রিমালের চেয়েও তাণ্ডবময়। তাকে নিয়ে যাওয়া, খুন করার বিবরণ, লাশ থেকে মাংস-হাড্ডি আলাদা করা, পরে পিস পিস করা, এক পর্যায়ে হলুদ মাখিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে দেওয়ার এক একটি বর্ণনায় মানুষকে বুঁদ করে ফেলা হয়েছে। ওই লাশের টুকরো খুঁজতে আবার পুলিশের কলকাতায় চলে যাওয়া। এ কি থ্রিলার? নাকি দাদাকে আদা পড়া দেওয়ার গাঁজাখুরি কিচ্ছা শোনানো? বর্ণনা মতো লাশ টুকরো টুকরো করে জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়ে থাকলে এখন খোঁজার প্রশ্ন কেন? মাছের পেট থেকে লাশ বের করে আনার জন্য? নাকি মাছগুলোকে ধরার জন্য?
এতোসব অভিযানের সমান্তরালে হানিট্র্যাপের নারী চরিত্রসহ কত কাহিনি? আনার তো চরম জনপ্রিয় রাজনীতিক! তিন তিন বারের এমপি কি এমনি এমনিই? লাল পাসপোর্টধারী এই লোকটি যে মরে গেছে বা তাকে মেরে ফেলা হয়েছে এই খবরের সোর্স কে? সোর্স হচ্ছে পুলিশ। সাংবাদিকরা বয়ানকারী। শুরুতে এটি ছিল একটি হারানো বিজ্ঞপ্তির মতো। এই মাননীয় আনার কলকাতায় নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা শুরুতে দেশের গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায়নি। টানা কয়েকদিন কোনো কোনো গণমাধ্যমে এটি প্রচার হয়েছে নেহাত নিখোঁজ সংবাদের মতো। তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ায় পাল্টে গেল দৃশ্যপটও। ব্রেকিং নিউজে তথ্যের কত যে ধুম। কারা কত দিন ধরে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছে, কীভাবে খুন করেছে আরও কত্তো প্রশ্ন। সাবেক নন, একজন টাটকা-তরতাজা মাননীয় পরম বন্ধু প্রতিবেশী দেশে গিয়ে টানা কয়েকদিন নিখোঁজ থাকলেন। দুদেশের পুলিশ গোয়েন্দারা হদিসই বের করতে পারল না! দেশটিতে নিযুক্ত আমাদের কূটনৈতিক মিশনও জানল না।
কেবল মাননীয় নন, যে কারও মৃত্যু সংবাদ জানার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম কাজ হচ্ছে ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন পাঠ করা। সমবেদনা জানানো। আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে বলা এবং বলানোর চেষ্টা চলে তাকে ‘বড় ক্লিনম্যান’ প্রচার করার। এমপি-মন্ত্রী হলে সংসদে শোক প্রস্তাব এনে কিছুক্ষণ তার প্রশংসা গাওয়া। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানানো। তাদের শোক সইবার ক্ষমতা দিতে আল্লাহর দরবারে দোয়া-খায়ের করা। এ শোক যেন শক্তিতে পরিণত হয় সেই কামনা করা। পরপারে তিনি যেন ভালো থাকেন সেই দোয়া করা। তিনি এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন বলে হত্যার শিকার হয়েছেন মর্মে তার দল থেকে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র স্যোশাল মিডিয়ায়। স্যোশাল মিডিয়া মাড়িয়ে মূলধারার কোনো কোনো গণমাধ্যমে সমানে মাননীয় আনারের কাণ্ডকীর্তি প্রচার করছে। স্বর্ণের কারবার থেকে হুন্ডি কিছুই বাদ পড়ছে না। তার মতো ক্লিন ইমেজের আরও কতজন মাননীয় আমাদের মহান জাতীয় সংসদে আছেন সেই রসময় আলোচনা তো আছেই। গত কয়েক বছর ধরে এই ক্লিন মাননীয়দের কারও কারও ক্রিয়াকর্ম রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে, ভাঙছে। তারা মহান। তারা বড় হওয়ার আইকন। সেই আইকনকে নিয়েই এখন এত এত কিচ্ছা? খুনের বর্ণনার কিচ্ছা তো বাংলা, হিন্দি বা হলিউডি ছবিকেও হার মানায়?
টাকা বানানো আর চিকিৎসা, দুটোর জন্যই কলকাতা উর্বরভূমি অনেক দিন থেকে। দুবাইও। এ কাজে যত্রতত্র ব্যবহৃত হয়েছে লাল পাসপোর্ট। রাজনীতির জন্যও একটা হাব। আর লুটপাট এবং মাস্তানতন্ত্রের মোজেজা একসঙ্গে ধরে রাখতে পারলে মাফিয়াভুক্ত হওয়া সহজ। দল এমন মালই খোঁজে। নির্বাচনী আসনে তা বহাল রাখতে পারলে কেল্লাফতে। আবার ঘটনাচক্রে কুকীর্তি বের হয়ে পড়লে দায় কেউ নিতে চায় না। পুলিশকেই তখন কিচ্ছা শোনাতে হয়। আর সেই কাসাস বা কিচ্ছা বর্ণনায় কামিয়াবি কর্মকর্তার জন্য থাকে বাড়তি ইনাম। গল্পের স্ল্যাট হিসেবে এটি চমৎকার। শ্রবণের পর সাংবাদিকরা তা বয়ান করেন একদম খাঁটি তথ্যের মতো করে। যেন কাছ থেকেই দেখেছেন যাবতীয় কায়কারবার। কেবল ক্রাইম নয়, অন্যান্য সেক্টরেও নিজস্ব অনুসন্ধান একেবারেই কম। জনাব ওমুক জানিয়েছেন, বলেছেন, আরও বলেছেন, উল্লেখ করেছেন ইত্যাদি ধরনের শব্দে রিপোর্ট কুল্লে খালাস হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা ওপেন সিক্রেট যে, দেশে অপরাধবিষয়ক বেশির ভাগ রিপোর্টিংয়ের সোর্স হচ্ছে পুলিশ। এক সময় এটা হতো গোপনে বা সঙ্গোপনে। এখন হয় ঘটা করে, প্রস্তুতি নিয়ে, সাংবাদিক ডেকে বিশেষ ফটোসেশনে। কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরপরই মিডিয়ায় এমন ডিটেইলিং দেওয়া ব্যক্তি হিরো হন। কিন্তু, ঘটনা বা মামলার মেরিটসহ কল-কবজা ঠিক থাকছে না। এমন একটা বাস্তবতার মধ্যেই সামনে আসে এমপি আনার ইস্যু। বলা হচ্ছে হত্যা। আসলে এখনো নিখোঁজ। এ নিয়ে মুখরোচক গল্পগুলোর জোগান পুলিশেরই দেওয়া। ঘটনাকে আরও চাঞ্চল্যকর করছে পুলিশই। সাংবাদিকরা তা প্রচার-প্রসারের সেতুবন্ধ। এসব খবর মানুষ বেশ খাচ্ছে। ক্লিক পড়ছে লাখ লাখ। বাজার ধরতে গিয়ে নিউজ টেবিল থেকেও দেরি না করে দ্রুত রিপোর্ট ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই সরাসরি লিখে দেওয়া হচ্ছে কে হত্যার পরিকল্পনা করেছে, কে কাকে ভাড়া করেছে খুনি হিসেবে, হত্যার পর কে কোথায় পালিয়ে গেছে। এগুলো পুলিশের মুখ থেকে শোনা। দু’চারদিনেই আনার হত্যা বা নিখোঁজের এতসব বের করে ফেলা পুলিশ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও সাগর-রুনি হত্যার একটা ক্লুও দিতে পারেনি। আনার হত্যার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সোর্স হিসেবে জানানো হয় কলকাতার পুলিশের কথা। কিন্তু, প্রমাণ দিতে পারেনি। ধরনটা বাংলাদেশের মতোই।
নারী ও যৌনতা এরইমধ্যে এ ঘটনায় যুক্ত হয়ে গেছে। ‘শিলাস্তি রহমান’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে আরও কত কিছু চলে আসছে। অবস্থাটা এমন হয়ে গেছে, ভুল-শুদ্ধ যা হোক অডিয়েন্স গ্রহণ করছে। পরে ভুল প্রমাণ হলে অবিশ্বাস করবে, ঝামেলা শেষ। তলিয়ে দেখছে না, আনারকে যে হত্যা করা হয়েছে এটা পুলিশ ও সাংবাদিক নিশ্চিত হলো কীভাবে? ঘটনার বিবরণ শোনাতে পুলিশ এত উৎসাহী কেন? লাশ কি পাওয়া গেছে? পাওয়া না গেলে লাশটা গেল কোথায়? লাশ কি নিজে নিজে কোথাও যেতে পারে? তার ওপর লাশের এত ফের শোনানো হচ্ছে কেন? কখনো বলা হয়েছে অর্ধগলিত লাশ, কখনো টুকরা-টুকরা। আবার বলা হচ্ছে এক্সপার্ট কসাই দিয়ে হাড়-মাংস কিমা বানিয়ে খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এমপির শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। গরু-ছাগল মুরগির মতো কি মানুষের চামড়া ছাড়ানো সম্ভব? এমন কিচ্ছা প্রচারের মধ্য দিয়ে আনারকে আর খোঁজা লাগবে না, সেটাই কি নিশ্চিত করা হলো? এখন লাশও মিলবে না সেই বার্তার মধ্য দিয়ে কোন আগামীর ইঙ্গিত? আমাদের মাননীয় বিদেশি কারাগারে থাকবেন, বিদেশে লাশ হয়ে টুকরা টুকরা হয়ে যাবেন আমরা কেবল এসবের কিচ্ছা শুনব?
রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ জগতের সম্পর্কটা বেশ পুরনো। একসময় বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আস্তানা হতো কলকাতায়। সেখান থেকেও তারা অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এখন তারাও বিশ্বায়নে। দুবাই, ব্যাংকক, কানাডাসহ আরও কত দেশে আলিশান অবস্থান তাদের। এখন আর রাখঢাক না রেখে মাননীয়রাও সেখানে শরিক। ঝিনাইদহ-৪ আসনের আনোয়ারুল আজীম আনারের ঘটনা না ঘটলে হয়তো তা নতুন করে আলোচনায়ও আসত না। মানুষ আজিজ-বেনজীর, ক্রিকেট-ফুটবল মাফিয়া, ঘূর্ণিঝড় রিমাল নিয়েই থাকত। মাঝেমধ্যে বুঁদ থাকত অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজির খবরের সালাদ-চাটনিতে। আনারের ঘটনা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের যে হালহকিকত দেখাল এর পরবর্তী এপিসোড ও কিচ্ছাকাহিনি কী হতে পারে, কে জানে! যতই বলা হোক, আগে রাজনীতি পরিচ্ছন্ন ছিল, আসলে ওই সময়ও রাজনীতিকদের অনেকে কারণে-অকারণে বা বিশেষ প্রয়োজনে কয়েক পিস ষণ্ডা-মাস্তান পালতেন। এখন মাস্তানরাই রাজনীতির দখল নিচ্ছে। মাঝেমধ্যে তাদের মধ্যে একটু ফ্রেন্ডলি ফায়ার হয়ে যায়। হতে পারে আলোচিত আনারও সেই ধরনের কিছুর শিকার। কিন্তু, তাকে নিয়ে এমন বর্ণনা জরুরি হয়ে পড়ল কেন?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
mostofa71@gmail.com
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |