প্রচ্ছদ জাতীয় বিএনপির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, সন্ত্রাসের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারছে না: পিনাকি

বিএনপির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, সন্ত্রাসের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারছে না: পিনাকি

বিএনপির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। দলটি সন্ত্রাসের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারছে না। তরুণদের বিশাল এক অংশের কাছে পুরাতন রাজনীতি ‘মৃত’। নতুন রাজনীতি শুরু করার সময় এসেছে।

বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ব্রডকাস্ট ডিজাইনার তানজিল ইসলাম তামিমকে চলতি মাসের শুরুতে ঢাকায় পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। পুলিশের তদন্তে দেখা যায়, ঘটনাতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। চার দিন পর, বিএনপি তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে।

তবে রবিউল ইসলাম একমাত্র বিএনপি সদস্য নন, যিনি আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক শূন্যতার ফায়দা নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হওয়া একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট ২০২৪-এ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে বিএনপির একাধিক নেতা চাঁদাবাজি ও জমি দখলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

২৪ সেপ্টেম্বর তারিখের গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি দ্য প্রিন্ট স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করেছে। এটাতে স্পষ্ট, বাংলাদেশে যদি শীঘ্রই সাধারণ নির্বাচন হয়, তাহলে বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতিবাচক অবস্থানের সুযোগ বিএনপি নেবে। এবং আওয়ামী-বিরোধী সে স্রোতের ওপর ভর করে এমনকি ক্ষমতায় চলে আসতে পারে।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, রাজধানীতে বাস মালিকদের থেকে চাঁদা আদায়, নারায়ণগঞ্জ তেলের ডিপো দখলের চেষ্টা—কিছু বিএনপি নেতারা কাউকে এবং কোন কিছুকেই ছাড়ছে না। দলের শীর্ষ নেতারা কিছু সদস্যকে বহিষ্কার করলেও, সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, ও চাঁদাবাজদের থেকে দলকে মুক্ত করা খুবই কঠিন, প্রায় অসম্ভব একটা ব‍্যাপার।

দলটির চেইন অব কমান্ড বা শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। শেখ হাসিনার আমলে দেখতে পাওয়া গুন্ডামির রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দলটি নেতৃত্বস্থানে থাকার কথা। অথচ তেমন ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ বলেও মনে হচ্ছে না বিএনপিকে। মূলত আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না তেমন। এটা স্পষ্ট যে দলটি নিজের গুন্ডাদের শুদ্ধি করার উদ্যোগ তো নিচ্ছে না এমন একটা সময়ে যখন ইউনূস সরকার গণতান্ত্রিক সংস্কার করতে চায়।

বরং হাসিনার অলৌকিকভাবে অপসারিত হবার সুযোগ নিতে চায় বিএনপি। ইদানিং, দলটি নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, দলটি ক্ষমতায় আসতে দ্রুত নির্বাচনের জন্য ‘ব্যাকুল’ হয়ে গিয়েছে।

হাসিনার পতন প্রকৃতই একটি অলৌকিক ঘটনা। কিন্তু বিএনপির এরচেয়ে বেশি অলৌকিক ঘটানা প্রত্যাশা করা উচিত হবে না।

বিএনপি—উত্থান ও পতন

জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, যিনি ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সবচেয়ে অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।

জিয়া একজন জেনারেল হলেও, তিনি এমন একটি মধ্যপন্থী দল গঠন করেন যা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তাঁর দলীয় কার্যালয়ে ছিল সবাই—পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী থেকে মুক্তিযোদ্ধা, সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট থেকে মাওবাদী এবং সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগার পর্যন্ত। এমনকি তিনি কিছু সময় সমাজতান্ত্রিক নীতিও অনুসরণ করেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বামপন্থী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি পর্যন্ত জিয়ার ‘খাল খনন কর্মসূচিতে’ অংশ নেয়।

জেনারেল এরশাদ রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের কয়েক বছর পর, জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলটির নেতৃত্ব নেন এবং তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু দলের ধীরে ধীরে অবনতি শুরু হয় এবং তা আওয়ামী লীগের শেষ মেয়াদে এসে এটি সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্যে পড়ে।

এখনও, দলীয় নেতৃত্ব জনগণের চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। ছাত্র-আন্দোলনের পর হাসিনার ভারত পালিয়ে যাওয়ার ১১ দিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, তার দল ওই আন্দোলনে জড়িত নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন আগে, বিএনপি একটি ঘরোয়া সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে তারা সরকারকে হুমকি দেয় যে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ইচ্ছাকৃতভাবে নিরীহ ছাত্রদের আক্রমণ করলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির একদিন আগে, আলমগীর একটি সংবাদ সম্মেলনে হাসিনার পদত্যাগ দাবি করেন। এই সংবাদ সম্মেলনটিও ঘরোয়াভাবে আয়োজিত। বিএনপি দলীয় নেতারা রাজপথে অনুপস্থিত ছিলেন এবং তাদের কেউ পরিস্থিতি বোঝার মতো জ্ঞান রাখেননি।

মুহাম্মদ ইউনুস যে গণজাগরণকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে অভিহিত করেছেন, তার নেতৃত্বদানকারী কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটিতে বিএনপির ছাত্র সংগঠনের একজন সদস্যও ছিল না।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, বিপুল সংখ্যক বিএনপি কর্মী এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন এবং প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। তবে, এও মনে করার কারণ আছে যে, দলটি প্রকৃত রাজনৈতিক সংস্কার চায় না, বরং ২০০২ সালের সেই সুখপূর্ণ সোনালি সময়ে ফিরে যেতে চায়। বিএনপির সর্বশেষ মেয়াদের সময়ের পত্রিকাগুলো তার নেতাদের, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের দুর্নীতির কাহিনিতে পরিপূর্ণ। একটি সুষ্ঠু বিচারে সেসব মামলা টিকবে না, কারণ হাসিনার আমলে বিচার ব্যবস্হা ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। তবে, তারেক রহমান বা বিএনপির নেতৃত্ব কোনো পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করেনি। কোনো প্রতিবাদপত্র পাঠাননি।

এসব প্রতিবেদনের একটিতে তারেক রহমানকে ‘দুর্নীতির গুরু’ বলা হয়েছে। ২০০৮ সালে প্রকাশিত ডেইলি স্টার-এর একটি প্রতিবেদন বলেছিল, “তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গ্রেফতার হওয়া পুত্র তারেক এবং মামুন ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদের পাহাড় গড়েছিল।” কোনো প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয়নি। তারেক রহমান কেন কোনো মানহানির মামলা করেননি তা ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত আমরা জানি না।

দুর্নীতির পাশাপাশি, তারেকের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা। “তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় ‘হাওয়া ভবন’ থেকে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল,” এমন আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডেইলি স্টারেই। প্রধান বিরোধী দলের নেত্রীকে হত্যার চেষ্টা একটি গুরুতর অপরাধ। এতো বছর পরেও, তারেকের কার্যালয় কোনো প্রতিবাদপত্র পাঠায়নি বা কোন আইনি পদক্ষেপ নেয়নি।

আমরা কি তবে ধরে নেব যে, তার এই নির্লিপ্ততার অর্থ এসব অভিযোগ সত্য, এবং তারেক কেবল ইস্যুগুলো এড়িয়ে যেতে চান? না কি তিনি ভাবছেন যে আজ না হয় কাল তার দল ক্ষমতায় আসবে এবং তার বিরুদ্ধে সব মামলা বাতিল হয়ে যাবে?

বিএনপি কি ক্ষমতায় আসছে?

বিএনপি বিশ্বাস করে, যদি শীঘ্রই একটি অবাধ নির্বাচন হয়, তারা ক্ষমতায় আসবে। দলটি ২০০৮-পূর্ব সময়ের তথ‍্যের ওপর নির্ভর করছে যখন বাংলাদেশে শেষবারের মতো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রায় ৬৩.৭ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স এখন ৩৫-এর নিচে এবং এদের অধিকাংশই হাসিনার একের পর এক প্রহসনের নির্বাচনে ভোট দিতে পারে নাই। কেউ জানে না তাদের ভোটের প্রবণতা— তারা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের অঙ্গীকার কখনও ঘোষণা করেনি। এ ছাড়াও, এই তরুণরাই গণআন্দোলনের সামনের সারিতে ছিল এবং তারা আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং বিএনপিকে দুর্বল হিসেবে দেখে বড় হয়েছে। তাদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামিকে একটি বিকল্প হিসেবে দেখে না কারণ দলটির ১৯৭১-এর ভূমিকার কারণে তা একটি বিতর্কিত ইতিহাস বহন করে, যা অধিকাংশ মিলেনিয়াল এবং জেন-জি কেবল বোঝা হিসেবে দেখে।

এই শূন্যতার সময়ে, মধ্যপন্থী শূন্যতা পূরণ করতে পারে এমন একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও জামায়াত উভয়কেই দুর্বল করে দিবে। অনেক তরুণের জন্য পুরনো বর্তমান পরিস্হিতি পুরানো রাজনীতির কবর রচনা এবং নতুন রাজনীতির বীজ বপনের সময়। বিএনপি নেতৃত্বের কাছে এসব বিষয় মোকাবেলা করার ক্ষমতা নেই। কারণ দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের হত্যা, স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির অভিযোগ যারা মিডিয়াতে করে আসছে তাদের মুখোমুখি হতে তিনি অনিচ্ছুক।

বাংলাদেশের একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল প্রয়োজন, এবং এটি স্পষ্ট যে বিএনপির সামনে এখনো অনেক পথ বাকি। বিএনপির যারা জমি দখল করছে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চাঁদাবাজি করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তারেক রহমানের উচিত তার অতীতের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কথা বলা এবং তার নির্দোষিতা প্রমাণের ব্যবস্থা নেওয়া। বর্তমান সময়ে, বিএনপির উচিত তরুণদের নেতৃত্বে আনা। দলটির বুঝতে হবে যে পুরনো রাজনীতি হাসিনার সঙ্গে ভারতে পালিয়ে গিয়েছে।

আহমেদ হুসাঈন (Ahmede Hussain) একজন বাংলাদেশি লেখক ও সাংবাদিক। লেখাটি প্রথম দ‍্যা প্রিন্টে ছাপা হয়।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।