প্রচ্ছদ জাতীয় বিএনপির নির্বাচনী প্রচারে আসছে যে নতুন মাত্রা

বিএনপির নির্বাচনী প্রচারে আসছে যে নতুন মাত্রা

আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রচারে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে বিএনপি। দলটি এবার মাঠের পাশাপাশি ডিজিটাল দুনিয়াতেও সমানভাবে সক্রিয় হতে চায়।

সে লক্ষ্যেই গঠন করা হচ্ছে নতুন একটি অনলাইন ও তৃণমূলভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম—‘বাংলাদেশ গ্রাসরুটস নেটওয়ার্ক’ (বিজিএন)। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিএনপি তাদের তৃণমূলের শক্তিকে সুসংগঠিত করবে এবং অনলাইন প্রচারকে আরও জোরদার করবে।

একই সঙ্গে অপপ্রচার মোকাবিলায় কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। বিজিএন গঠনের প্রস্তাব এরই মধ্যে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর অনুমোদিত হয়েছে।

দলটির পরিকল্পনা অনুযায়ী, খুব শিগগির সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার ১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। প্রত্যেক কেন্দ্রীয় নেতা ২০টি আসনের সমন্বয় করবেন।

বিজিএন–এর অধীনে দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনে দুজন করে মোট ৬০০ জন স্নাতক পাস অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। এই অ্যাক্টিভিস্টরা সরাসরি তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করবেন এবং নিয়মিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। তাদের প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সম্মানী দেওয়া হবে।

বিজিএন স্থায়ী কমিটিতে নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেবে, যা দলের নীতিনির্ধারণী আলোচনায় ব্যবহৃত হবে। এরই মধ্যে সম্ভাব্য অ্যাক্টিভিস্টদের সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী জমা পড়েছে এবং সেখান থেকে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৮ অক্টোবর বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বৈঠকে বিজিএন-এর কাঠামো ও কার্যক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

দলটির ধারণা, এই নতুন উদ্যোগ শুধু তৃণমূল স্তরে সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াবে না, একই সঙ্গে অনলাইন স্পেসেও ‘বট বাহিনী’র প্রভাব মোকাবিলায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।

বিএনপির লক্ষ্য হলো—নির্বাচনী প্রচারে অনেক আগেই দলের বার্তা দেশের প্রতিটি প্রান্তে এবং অনলাইন মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে পৌঁছে দেওয়া। বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, বিজিএনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রাথমিকভাবে ১৫ জন নেতা থাকবেন, প্রয়োজনে এ সংখ্যা বাড়ানো হবে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বই সংগঠনের সব কার্যক্রম তদারকি করবেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মাঠ পর্যায়ের কাঠামো—দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে দুজন করে অ্যাক্টিভিস্ট নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা হবেন তৃণমূল পর্যায়ে বিজিএন-এর মূল চালিকাশক্তি। অ্যাক্টিভিস্ট নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিএনপি চাইছে শিক্ষিত ও সচেতন তরুণদের এ প্রচারে যুক্ত করতে।

এজন্য নির্ধারিত করা হয়েছে—অ্যাক্টিভিস্টদের অন্তত স্নাতক ডিগ্রিধারী হতে হবে। দলটির বিশ্বাস, তথ্যভিত্তিক প্রচার পরিচালনা এবং যুক্তিনির্ভর আলোচনায় অংশ নেওয়ার সক্ষমতা এ তরুণদের বেশি।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, অ্যাক্টিভিস্টদের মাসিক সম্মানী দেওয়া হবে। যদিও এটি সামান্য অঙ্ক, তবু দলের প্রতি তাদের অঙ্গীকার ও সময় দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করবে।

বিএনপির কয়েকজন সাংগঠনিক নেতা জানিয়েছেন, বিজিএনের মূল লক্ষ্য হলো ‘বট বাহিনীকে প্রতিরোধ করা’। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘বট বাহিনী’ বলতে বোঝানো হয়—সংগঠিত অনলাইন গোষ্ঠী, যারা স্বয়ংক্রিয় বা পরিকল্পিতভাবে বিরোধী মতকে দমন করে বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বার্তা প্রচার করে।

বিএনপি মনে করে, এ ধরনের অপপ্রচার ও ভুল তথ্য তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং নির্বাচনী প্রস্তুতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএন-এর অ্যাক্টিভিস্টরা তথ্যভিত্তিক ও যুক্তিসংগত পাল্টা প্রচারের মাধ্যমে এই অপপ্রচার মোকাবিলা করবেন।

তারা ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), ইনস্টাগ্রাম, টিকটকসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দলের অবস্থান, কর্মসূচি এবং প্রতিপক্ষের ব্যর্থতা ও অনিয়ম তুলে ধরবেন। তৃণমূলের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জনমত অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়ে তারা কৃত্রিম প্রচারকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন।

বিএনপির নেতারা মনে করেন, বিজিএন-এর সফল কার্যক্রম শুরু হলে এটি দলের নির্বাচনী প্রচারে নতুন গতি আনবে। দলটির অভ্যন্তরে যেভাবে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অনলাইন উপস্থিতির ঘাটতি ছিল, এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সেটি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

বিজিএন-এর দুটি প্রধান উদ্দেশ্য—প্রথমত, তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী করা; দ্বিতীয়ত, অনলাইন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তথ্যযুদ্ধে নিজেদের অবস্থান মজবুত করা। বিজিএন-এর একজন শীর্ষ সংগঠক বলেন, ‘এটা নতুন কোনো সংগঠন নয়, বিএনপিরই একটি অংশ। এটি দলের গ্রাসরুটস নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করবে। ৩০০ আসনে আমাদের প্রতিনিধি থাকবে। তাদের মূল কাজ হবে—দলের ভাবনা, নীতি ও কন্টেন্ট তৃণমূলে পৌঁছে দেওয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এবং প্রথাগত মিডিয়া—উভয় মাধ্যমে। প্রত্যেক উপজেলায় প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক, পোর্টাল—এসব আছে।

আমরা মনে করি, মানুষের জানা দরকার আমাদের বার্তাগুলো। তাই আমরা সেগুলো একযোগে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। এখন চিন্তাভাবনা চলছে, চূড়ান্ত হলে খুব শিগগির প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জানানো হবে।’

বিএনপির মিডিয়া সেল বর্তমানে অনলাইন প্রচারে বিশেষভাবে সক্রিয়। ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাদের শক্তিশালী উপস্থিতি আছে। বিএনপি মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজে ৩৩ লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে, আর ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি’ পেজে অনুসারীর সংখ্যা ৩৮ লাখেরও বেশি। ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার ৩৮ হাজারের বেশি এবং এক্স-এ অনুসারী প্রায় ১ লাখ। সরকার পরিবর্তনের পর এক্সে দলের অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

পাশাপাশি, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামেও দলের তরুণ কর্মীদের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া সাংগঠনিক যোগাযোগের জন্য বিএনপির আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম চ্যানেল রয়েছে।

২০২২ সালের ২২ জুন গঠিত বিএনপি মিডিয়া সেলের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে পৃথক ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছে, যেখানে নিয়মিতভাবে দলের কর্মসূচি ও রাজনৈতিক বার্তা প্রচার করা হয়।

দলটির নেতারা মনে করছেন, বিজিএন কার্যকরভাবে কাজ করতে পারলে এটি বিএনপির প্রচারের কৌশলে নতুন দিক উন্মোচন করবে।

এটি একদিকে যেমন তৃণমূলের মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি ডিজিটাল মাধ্যমে দলের বক্তব্য ও ভাবমূর্তি আরও সুসংহত করবে।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির ‘বিজিএন’ প্ল্যাটফর্ম দলের রাজনৈতিক প্রচারে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।