রাজনীতি: একদফার আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত ফল না আসার কারণ চিহ্নিত করার পর শিগগিরই সাংগঠনিক অ্যাকশনে যাচ্ছে বিএনপি। গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি বলে মনে করে দলটি। এমন মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিগগির ভেঙে দেওয়া হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। এরই মধ্যে দুই সংগঠনের পুরো নেতৃত্ব বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে নিষ্ক্রিয় সাংগঠনিক জেলাগুলোও পুনর্গঠন করা হবে। রোজার মাসজুড়ে এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলবে। এ ছাড়া আগামী দিনে আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃতদের দলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাংগঠনিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে গত কয়েক দিনে দলের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে হাইকমান্ডের সিরিজ বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার বিরোধী দল ও বিরোধী দলের সংগঠনকে নিশ্চিহ্ন করতে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বাধাগ্রস্ত করছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই যতদূর সম্ভব আমাদের দলকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি। কমিটি গঠন, পুনর্গঠন একটা চলমান প্রক্রিয়া, এটা চলতেই থাকবে।’ বিএনপি এক বছরের বেশি সময় ধরে রাজপথে আন্দোলন করলেও চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। প্রত্যাশিত হারে নেতাকর্মীরা রাজপথে না নামায় গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে প্রথম ধাক্কা খায় দলটি। ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে সাংগঠনিক এই সীমাবদ্ধতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তাদের ২৬ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় গ্রেপ্তার এড়াতে বাকি নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ঘুরেফিরে অল্প কিছু নেতা হরতাল-অবরোধের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল করেন। এ চিত্র রাজধানী ঢাকা থেকে দলের তৃণমূল পর্যন্ত সর্বত্র। হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও নেতাকর্মীরা প্রত্যাশিত হারে মাঠে নামেননি। এর মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি সামনে চলে আসে—যা হাইকমান্ডের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনের আহ্বান জানায় বিএনপি। তবে তাদের বর্জনের মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপির দাবি, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ভোট বর্জন করেছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক পরাজয় এবং তাদের নৈতিক বিজয় হয়েছে। তবে রাজপথের কর্মসূচিতে সরকারের পতন না হওয়ায় নির্বাচনের পর পরই আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন শুরু করে বিএনপির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে এ পর্যালোচনা শেষ হয়েছে। তার ভিত্তিতেই দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এখন সংগঠন পুনর্গঠনে হাত দিচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে এ পুনর্গঠনের রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই ছাত্রদল ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হবে। কারণ এই দুটি সংগঠনের যারা নেতৃত্বে আছেন, আন্দোলনে তাদের ভূমিকায় হাইকমান্ড চরম হতাশ। দলের মূল্যায়ন, বিক্ষিপ্তভাবে পাঁচ-দশজন নিয়ে পৃথক পৃথক মিছিল হলেও ছাত্রদল বা যুবদল বড় জমায়েত নিয়ে কোনো মিছিল করতে পারেনি। শীর্ষ নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া জেলা নেতাদের সঙ্গেও কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন সমন্বয় ছিল না। নির্বাচনের পরে ধারাবাহিক জুম মিটিংয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে এসব অভিযোগ করেছেন তৃণমূল নেতারা। তবে স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি হাইকমান্ড।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৭ মে যুবদলের আট সদস্যের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। নয় মাসের মাথায় সংগঠনটির ২৫১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ তিন বছর। অন্যদিকে ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ৩০২ সদস্যের আংশিক পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হয়। ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এই কমিটিতে আরও ৮৯ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ দুই বছর। এর মধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিতে উপস্থিত না থাকায় দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার জায়গায় সিনিয়র সহসভাপতি রাশেদ ইকবাল খানকে সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। কিন্তু আন্দোলনের একেবারে শেষদিকে মাত্র কয়েকটি কর্মসূচিতে তাকে মাঠে দেখা যায়। সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলকেও মাত্র দু-একটি কর্মসূচিতে দেখা গেছে। অবশ্য তার ঘনিষ্ঠদের দাবি, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের দিন তিনি আহত হয়েছিলেন। অন্যদিকে যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু কয়েকটি কর্মসূচিতে মাঠে থাকলেও একপর্যায়ে তাকে গ্রেপ্তারে তৎপর হয় পুলিশ। এ কারণে তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। ওই অবস্থায় তিনি আন্দোলন সংগঠিত করতে নেপথ্য ভূমিকা রেখেছেন বলে দাবি ঘনিষ্ঠদের। তবে তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, আন্দোলন চলাকালে যুবদল সভাপতি জেলা নেতাদের সঙ্গে সঠিকভাবে সমন্বয় করেননি।
অন্যদিকে যুবদল সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্নাকে গত বছরের ৯ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আন্দোলনের পুরো সময় তিনি কারাগারে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। নির্বাচনের পর গত ৩০ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পান তিনি। জানা গেছে, যুবদল ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আছেন নতুন কমিটিতে তাদের কাউকেই রাখার সম্ভাবনা নেই। দুই সংগঠনেই মূল নেতৃত্বে নতুন মুখ আনা হবে। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। নতুন নেতৃত্বের জন্য বিবেচনায় থাকা কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। অনেকে বলছেন, রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ও যোগ্যদের দিয়ে এই পুনর্গঠন করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে পুনর্গঠনের নামে ‘পকেট কমিটি’ গঠন করলে আগামীর আন্দোলনেও তেমন সুফল পাওয়া যাবে না। বিগত আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে এই পকেট কমিটিকেই দায়ী করেছেন তারা। তাদের অভিযোগ, দু-তিন বছর ধরে কেন্দ্রসহ সারা দেশে দল ও অঙ্গ সংগঠনের যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই ছিল পকেট কমিটি এবং সেখানে ব্যাপক আর্থিক লেনদেন হয়েছে। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে যুবদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। এতে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সাবেক ছাত্রনেতারা মূল দায়িত্ব পেতে পারেন। এদের অনেকে বর্তমানে বিএনপির নির্বাহী কমিটিতে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও অঙ্গ সংগঠনের কমিটিতে নেই। এক্ষেত্রে রাজপথে সক্রিয় থাকা সাবেক ছাত্রনেতাদের ভাগ্য খুলতে পারে। যুবদলের ভেতর থেকেও নতুন নেতৃত্ব আসতে পারে। আর এই সংগঠনের বর্তমান কমিটির সুপার ফাইভে থাকা নেতাদের বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দেওয়া হতে পারে।
অন্যদিকে ছাত্রদলের কমিটি ইলেকশনে না সিলেকশনে গঠিত হবে, শীর্ষ পদের জন্য সর্বনিম্ন কোনো শিক্ষাবর্ষ রাখা হবে, বিবাহিতদের জন্য সুযোগ থাকবে কি না—এসব বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উপযুক্ত পরিবেশ থাকলে ঢাকা মহানগর, ঢাকা জেলা ও মহানগরের যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি রয়েছে, সেখানে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করার আলোচনা রয়েছে। সেটা সম্ভব না হলে সিলেকশনে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। জানা গেছে, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই ছাত্র ও যুবদলের নতুন কমিটি গঠনের চিন্তাভাবনা রয়েছে হাইকমান্ডের। তবে এই প্রক্রিয়া রোজার মাস পর্যন্ত যেতে পারে। সারাদেশে বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। দলের মূল্যায়ন, আন্দোলনে ২০ থেকে ২৫টি জেলার পারফরম্যান্স সন্তোষজনক ছিল না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুধু এসব জেলা ও মহানগরে দল ও অঙ্গ সংগঠনের কমিটি ভেঙে আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয়দের দিয়ে কেন্দ্র থেকে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও ওই কমিটির নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় থাকলে সেই কমিটি বিলুপ্ত করা হবে না। রমজান মাসজুড়ে তৃণমূলে এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলতে পারে। এদিকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া নেতাদেরও দলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আন্দোলনে যেসব নেতা নিজেরা সরাসরি মাঠে সক্রিয় ছিলেন কিংবা তাদের বলয়ের নেতাকর্মীরা রাজপথে ছিলেন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করেছেন, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রায় ২৫ জন নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। তাদের পদোন্নতি দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আন্দোলন ও দল পুনর্গঠন সমানভাবেই চলছে। ২০২২ সাল থেকে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হওয়ায় দল পুনর্গঠন কার্যক্রম কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। তবে ওই বছরও অনেক জেলায় সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। দু-একটি ছাড়া সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠন হয়েছে। নির্বাহী কমিটির পদও প্রয়োজন মতো পূরণ করা হচ্ছে।’
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |