প্রচ্ছদ জাতীয় বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন আসিফ মাহমুদ? নতুন কৌশলে বিএনপি

বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন আসিফ মাহমুদ? নতুন কৌশলে বিএনপি

রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী জোট গঠনে সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্র এবং নির্বাচনী জোট করতে চাওয়া দলগুলোর ক্ষেত্রে এ প্রভাব ইতোমধ্যে সামনে এসেছে।

নতুন আরপিও অনুযায়ী জোট করলেও নিবন্ধিত দল হিসেবে প্রার্থীকে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। এতে বিএনপির সঙ্গে জোট করেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ না থাকায় অন্তত দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা নিজ দল বিলুপ্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দিয়ে প্রার্থিতা নিশ্চিত করেছেন।

জোট করতে আগ্রহী দলগুলোর চিন্তা– ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে না পারলে জিতে আসা কঠিন হতে পারে। আর বিএনপি মনে করছে, জোটের এমন প্রার্থী হেরে গেলে তাদের আসন কমার ঝুঁকি তৈরি হবে। ফলে প্রার্থী আত্তীকরণের কৌশল নিয়েছে দলটি।

বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, আরও কয়েকটি ছোট দলের নেতারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে বিএনপিতে আসতে চাইছেন। আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে ৫৭টি দল ও জোট বিএনপির সঙ্গে ছিল। আগামী সংসদ নির্বাচনে দলগুলো ২২২টি আসনের দাবি করেছে বিএনপির কাছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, ‘আসন সমঝোতা নিয়ে শরিকদের সঙ্গে ইতোমধ্যে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আশা করছি, বিষয়টি দু-এক দিনের মধ্যেই সুরাহা হয়ে যাবে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হবে।’ শরিকদের সঙ্গে কয়টি আসনে সমঝোতা হতে পারে– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। এখনই কিছু বলা যাবে না।

বিএলডিপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম
বিএনপি দুই দফায় ২৭২ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণার পর জোটে আসতে চাওয়া দলগুলোর নেতাদের মধ্যে চাপ তৈরি হয়। বিশেষ করে জোটের আলোচনায় থাকা নেতাদের আসনে বিএনপি এককভাবে প্রার্থী দেওয়ার পর জোটের আলোচনার চিত্র বদলাতে থাকে।

গত ৮ ডিসেম্বর ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএলডিপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম নিজের দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর তাঁকে লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে বিএনপি। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি এলডিপির হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন।

তবে দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগদানের বিষয়টিকে মানতে পারেননি তাঁর দলেরই কয়েক নেতাকর্মী। তারা পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে শাহাদাত হোসেন সেলিমের ওই সিদ্ধান্তকে বেআইনি ঘোষণা করেছেন।

বিলুপ্ত জাতীয় দল, এহসানুল হুদা বিএনপিতে
সমমনা ১২ দলীয় জোটের আরেক শীর্ষ নেতা জোটের মুখপাত্র ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দলের নেতা শেখ মজিবুর রহমান ইকবালকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে ১২ দলীয় জোট চাপে পড়ে। এ অবস্থায় বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শে গতকাল সোমবার জাতীয় দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগদান করেন সৈয়দ এহসানুল হুদা।

সূত্র জানায়, এর মধ্য দিয়ে নিজের আসন নিশ্চিত করেন তিনি। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হবেন তিনি।

এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদ দল বিলুপ্ত করবেন না
১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদের দলটির নিবন্ধন নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি নড়াইল-২ আসন থেকে ধানের শীষে নির্বাচন করেছিলেন। এবারও তিনি এই আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছেন এবং সেভাবে প্রস্তুতিও নেন। তবে দ্বিতীয় দফায় বিএনপির ঘোষিত তালিকায় এই আসনে মনিরুল ইসলামকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। এখন নির্বাচন করতে ফরিদুজ্জামান ফরহাদও বিএনপিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি দল বিলুপ্ত করবেন না বলে জানিয়েছেন।

মোস্তফা জামাল হায়দারও আসছেন বিএনপিতে
১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের দল নিবন্ধিত নয়। তিনি পিরোজপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। তিনিও বিএনপিতে যোগদান করে ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবেন– এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে তাঁর দল বিলুপ্ত করা হবে কিনা, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ধানের শীষ প্রতীক পেতে কৌশল করবে এনডিএম
যোগদানের তালিকায় অন্য নেতাদের মধ্যে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজের নামও রয়েছে। নিবন্ধিত এনডিএম থেকে তিনি পদত্যাগ করে যে কোনো সময়ে বিএনপিতে যোগদান করতে পারেন বলে দল দুটির সূত্রে জানা গেছে। তবে ববি হাজ্জাজ তাঁর দল বিলুপ্ত করবেন না। তাঁর স্ত্রীকে এনডিএম চেয়ারম্যান করা হতে পারে।

ইতোমধ্যে ববি হাজ্জাজ নিজ দল থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। যে কোনো সময়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দেবেন এবং ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ঢাকা-১৩ আসনে নির্বাচন করবেন।
এ বিষয়ে ববি হাজ্জাজ সমকালকে স্পষ্ট করে কিছু না জানালেও তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের কারণে তারা কিছু জটিলতায় পড়েছেন। সেক্ষেত্রে কৌশলগত কারণে তারা কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে সেটা এখনই বলা যাবে না।

বিএনপির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের টানাপোড়েন
আসন সমঝোতা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সম্পর্কের টানাটানি চলছে। গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে গত অক্টোবরে বিএনপির কাছে ৩৫টি আসনের তালিকা জমা দেওয়া হয়। পরে তালিকা কাটছাঁট করে ২৫ আসনে নামানো হয়। তবে গত রোববার রাতে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১০টি আসনের দাবি তোলে গণঅধিকার পরিষদ। এর মধ্যে নিম্নকক্ষে সাতজন, উচ্চকক্ষে দুজন এবং একজন নারী সংরক্ষিত আসন।

বিএনপির পক্ষ থেকে নিম্নকক্ষে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের জন্য পটুয়াখালী-৩, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানের জন্য ঝিনাইদহ-২ আসন ছাড় দেওয়ার বিষয় নিশ্চিত করা হয়। পাশাপাশি উচ্চকক্ষ ও সংরক্ষিত আসনের দাবি মানার কথাও জানানো হয়। তবে এতে রাজি হননি গণঅধিকার পরিষদের নেতারা। তারা নিম্নকক্ষে চারটি আসনের কম মানবেন না বলে জানান। এতে সমঝোতা ভেস্তে যায়।

গণঅধিকার পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হাসান মামুন সমকালকে বলেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে কোনো জোট বা আসন সমঝোতায় যাবে না গণঅধিকার পরিষদ। গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ গণঅধিকার পরিষদ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করবে। বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা কিংবা জোটের আলোচনার আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটবে আজ। দলটির নেতাকর্মীরা জানান, আসন সমঝোতায় দলের সিনিয়র সভাপতি ফারুক হাসান ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হাসান মামুনের আসন নিশ্চয়তা না পাওয়ায় দল বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিএনপির সঙ্গে দুই আসন নিয়ে সমঝোতা হলে দলটি ভেঙে যেতে পারে– এই আশঙ্কা থেকে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে।
সূত্র জানায়, গণঅধিকার পরিষদ না গেলেও তাদের কেউ কেউ বিএনপিতে যোগদান করে নির্বাচন করার সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে।

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে নিয়ে গুঞ্জন
অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও বিএনপিতে যোগদান করতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে। বিএনপির একটি সূত্রও এমনটা আভাস দিয়েছে। তবে তিনি কবে যোগদান করবেন, তা পরিষ্কার নয়। বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচন করতে গতকাল মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এই আসন থেকে প্রার্থী হতে নিজেই থানা নির্বাচনী কার্যালয়ে গিয়ে মনোনয়ন ফরম তোলেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে সামনের কাতারে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ গত বছর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। ভোটে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা পোষণের পর নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগের দিন গত ১১ ডিসেম্বর তিনি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।

যদিও এই আসনে বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল ইসলামকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১৮ সালের উপনির্বাচনেও এই আসন থেকে ধানের শীষে নির্বাচন করেছিলেন তিনি।

নিজস্ব প্রতীকে লড়বেন অন্যরা
এই দলগুলো ছাড়া গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা-১৭, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব অসুস্থ হওয়ায় লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে তাঁর স্ত্রী তানিয়া রব, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক, কুমিল্লা-৭ আসনে দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি উবায়দুল্লাহ ফারুক সিলেট-৫, মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী নীলফামারী-১, জুনায়েদ আল হাবিব ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, মনির হোসেন কাসেমী নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মিত্র দলের নেতারা নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মিত্র দল হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চ জোট, ১২ দলীয় জোট, ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, বিজেপি, গণঅধিকার পরিষদ, এনডিএম, চারদলীয় বাম জোট, লেবার পার্টিসহ প্রায় ৫৭টি দল ও জোট ছিল। এ দলগুলো মিলে মোট ২২২টি আসনের দাবি করেছিল বিএনপির কাছে।

এর মধ্যে সাবেক বিএনপি নেতা অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি (লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি) ৪০টি আসন দাবি করেছিল। ১২-দলীয় জোট চেয়েছিল ২১টি, গণফোরাম ১৫টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ৯টি, বিজেপি (বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি) পাঁচটি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ছয়টি এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম) ১০টি আসন চেয়েছিল।

সূত্র : সমকাল