প্রচ্ছদ আন্তর্জাতিক বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি কি ভারতের নতুন মাথাব্যথার কারণ?

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি কি ভারতের নতুন মাথাব্যথার কারণ?

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভুত্থানে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন স্বৈরশাসক হাসিনা। বাংলাদেশ থেকে পালানোর পর পর হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন এবং তখন থেকেই সেখানে বসবাস করছেন।

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী বলে মনে হয়েছিল, গত কয়েক মাস ধরে তা ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারতের বর্তমান সম্পর্ক এবং এ বিষয়ে বিশ্লেষকদের মতামত এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে বিবিসি উর্দু।

এতে বলা হয়, সম্প্রতি ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করেছে বাংলাদেশ। এত দিন বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ ছিল। গত মঙ্গলবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) স্থলপথে সুতা আমদানির সুবিধা বন্ধ করে দেয়।

এর কয়েকদিন আগে ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া তাদের ‘ট্রান্সশিপমেন্ট’ সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গত সপ্তাহে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ভারত হয়ে বাংলাদেশে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা থাকায় দেশটির (ভারত) অনেক বন্দর ও বিমানবন্দরে ট্রাক-কনটেইনার ইত্যাদির জট উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে; যার কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

তবে দুই দেশের রাজনীতির ওপর নজর রাখা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক চীন সফরে ভারতের সেভেন সিস্টার্স (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য) নিয়ে করা মন্তব্যের পর এই বাণিজ্য সুবিধা বাতিল হলো।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফরের সময় ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য সম্পূর্ণরূপে ল্যান্ডলকড (স্থলবেষ্টিত)। সমুদ্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। আমরাই এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।’

ড. ইউনূসের এই মন্তব্য নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ড. ইউনূসের এই বক্তব্যকে হুমকি হিসেবে পাঠ করছেন তারা।

ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের বৈঠকের কয়েকদিন পর ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা করে ভারত।

গত ১৭ এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় ভারত। আমরা একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পক্ষে।

উল্লেখ্য, ভারতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের টার্গেট করার মতো বিষয়গুলোও দুই দেশের মধ্যে সমস্যা বাড়াচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলন চলাকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ড. ইউনূস প্রায় ৪০ মিনিট ধরে বৈঠক করেছিলেন।

ওই বৈঠকে মোদি বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টি উত্থাপন করেন। একই সঙ্গে ড. ইউনূস তার কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য ঢাকার অনুরোধ সম্পর্কে জানতে চান।

চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফরের সময় ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য সম্পূর্ণরূপে ল্যান্ডলকড (স্থলবেষ্টিত)। সমুদ্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। আমরাই এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক।’

ড. ইউনূসের এই মন্তব্য নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

ব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ড. ইউনূসের মধ্যে বৈঠকের পর ভারত সরকার জানায়, প্রধানমন্ত্রী মোদি মোহাম্মদ ইউনূসকে ‘পরিবেশ নষ্ট করে এমন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে’ বলেছেন। ’

আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল, চীন ও পাকিস্তানের সহায়তায় লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি পুনরায় চালু করার পরিকল্পনা বিবেচনা করছে বাংলাদেশ; যা ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছে এবং ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

সূত্রের বরাত দিয়ে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. ইউনূস চীন সফরের সময় বিমানঘাঁটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। এই প্রকল্পে পাকিস্তানের জড়িত থাকার খবরও পাওয়া গেছে।

গত ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমিনা বালুচ ঢাকায় আসেন। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়। যেখানে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি বাণিজ্য সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়েছিল।

কয়েকদিন পরই পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকা সফরে যাচ্ছেন। ২০১২ সালের পর এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসছেন।

এছাড়া তিস্তা প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকে বাংলাদেশের স্বাগত জানানোর বিষয়টিকে উদ্বেগের চোখে দেখছে ভারত।

এমন প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে কিনা তা নিয়েও আলোচনা বাড়ছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপকালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন ড. ইউনুস।

তিনি বলেন, আমাদের সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি, আমাদের সম্পর্ক ভালো আছে এবং ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে। আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল, ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ যে আমরা তাদের থেকে বিচ্যুত হতে পারি না।

তবে একই সঙ্গে উদ্বেগের সম্ভাবনার কথাও স্বীকার করেছেন ড. ইউনুস।

ওই সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতে মিথ্যা প্রচারণার কারণে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এই ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করছি।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কোনো বৈধতা নেই

বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছিল সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন। এটা বোঝা জরুরি যে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। ক্ষমতার এই পালাবদলের পর জামায়াতে ইসলামীসহ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের ধরন অবশ্যই ভিন্ন। তারা ১৯৭১ সালের আগের পুরোনো সম্পর্কে ফিরে যেতে যাচ্ছে, সেটা পাকিস্তান বা অন্য যে কোনো দেশের সঙ্গেই হোক।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বীণা সিক্রি বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অতীতেও সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশ চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম পেয়ে আসছে এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ হয়েছে, এখানে নতুন কিছু নেই।

তিনি বলেন, ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভারতের নিরাপত্তা সীমা মেনে চলা।

বর্তমানে বাংলাদেশে পাকিস্তানের গুরুত্ব বেশি!

দিল্লির ‘অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্টাডিজ অ্যান্ড ফরেন পলিসি’ বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক হর্ষ ভি পন্থ ‘বিএনপির’ উদাহরণ টেনে বলেন, অতীতেও বাংলাদেশে এমন সরকার ছিল যারা ভারত সম্পর্কে খুব একটা ইতিবাচক ছিল না। শেখ হাসিনা পুরোপুরি একপেশে শাসক ছিলেন এটাও বলা ভুল হবে। তার আমলেই চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়। তিনি ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন।

তার মতে, যে কোনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে দু’দিকেই লালন করতে হয়।তবে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ইউনুস প্রশাসন ভারতের প্রতি বিশেষ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়েছে।

অধ্যাপক পন্থ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রশাসন এমন অনেকে চালাচ্ছেন যারা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে বেশি তৎপর।

তিনি বলেন, চীন এখন মুখ্য নয়, পাকিস্তান এখন বাংলাদেশে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ; যা অস্বাভাবিক।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কি অবনতি হয়েছে?

তাহলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক খারাপ বলা কি ঠিক হবে? এমনটাই মত অধ্যাপক হর্ষ পন্থের। তার মতে, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

বাংলাদেশের নতুন প্রশাসন যেভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সামাল দিয়েছে, তাতে নিশ্চিতভাবেই সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে এবং দুর্ভাগ্যবশত এই মনোভাব পরিবর্তন করার কোনো ইচ্ছা তাদের আছে বলে মনে হয় না। আমি মনে করি না যে, আমরা আগামী সময়ে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন দেখতে পাব।

অধ্যাপক পন্থের মতে, শেখ হাসিনার সঙ্গে যেহেতু ভারতের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, তাই শেখ হাসিনার বিদায়ের পর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বীণা সিক্রিও একমত যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

বীণা বলেন, আমার মনে হয় না এই মুহূর্তে ভালো সম্পর্ক চলছে।

ভারতের জন্য এটা কতটা উদ্বেগজনক?

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি কি ভবিষ্যতে ভারতের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে?

প্রফেসর পন্থ বলেন, যখন আপনার এমন একজন সঙ্গী থাকে যাকে আপনি এতদিন ধরে লালন-পালন করেছেন, কিন্তু তার সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতো নেই। সুতরাং এটা অবশ্যই ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনার আমলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক অনেক এগোচ্ছিল। সেগুলো কানেক্টিভিটি, বাণিজ্য, কৌশলগত সম্পর্ক বা সীমান্ত ইস্যু যাই হোক না কেন। এই সব সমস্যার সমাধান হয়নি।তবে পরিস্থিতি এমন ছিল যেখানে এটি কোনো সমস্যা ছিল না, তবে এখন সবকিছু নেতিবাচক দেখাচ্ছে। ‘

অধ্যাপক পন্থের মতে, বর্তমান সময় বাংলাদেশের জন্যও অনুকূল নয়।

তিনি বলেন, আমরা যদি আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকাই এবং কয়েক মাস আগে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দিয়েছিলেন।

সূত্র: যুগান্তর