
‘নির্বাচন শুধু জনগণ দিয়ে নয়…যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেপ্তার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে।’ আগামী সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা ও অস্ত্র ঢুকবে আশঙ্কা প্রকাশ করে এমন বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী।
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের জিইসি কনভেনশন হলে জামায়াত আয়োজিত ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলন’-এ দেওয়া শাহজাহান চৌধুরীর এ বক্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে তোলপাড়। প্রতিবাদ জানিয়ে শাহজাহান চৌধুরীকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চট্টগ্রাম মহানগর এক বিবৃতিতে বলেছে, শাহজাহান চৌধুরীর ওই বক্তব্য সুশাসন ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং মাফিয়াতন্ত্র কায়েমের ইঙ্গিত বহন করে।
এদিকে শাহজাহান চৌধুরী দাবি করেছেন, খণ্ডিত বক্তব্য প্রচারে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য প্রচার-প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রাম জোনের প্রধান মুহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, শাহজাহান চৌধুরীর এ বক্তব্য তার নিজস্ব, দলের বক্তব্য নয়। শনিবার সন্ধ্যায় নগরের জিইসি কনভেনশন হলে ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলন’-এ প্রধান অতিথি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তবে শাহজাহান চৌধুরীর এ বক্তব্যের সময় তিনি মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন না।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের জামায়াত প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারকে দাঁড়িপাল্লার কথা বলতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক, নুরুল আমিন (নগরের সেক্রেটারি) ভাইয়ের ফটিকছড়িতে দাঁড়িপাল্লার কথা বলতে হবে। পুলিশকে আপনার পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে। ওসি সাহেব আপনার কী প্রোগ্রাম, তা সকালবেলায় জেনে নেবেন আর আপনাকে প্রটোকল দেবেন।’ তিনি বলেন, ‘টিএনও (ইউএনও) সাহেব যা উন্নয়ন এসেছে, সব উন্নয়নের হিসেব যিনি নমিনি (জামায়াতের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী) তার থেকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘প্রশাসন আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে’— শাহজাহান চৌধুরীর এ বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জামায়াতের এ নেতাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি। গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মো. এরশাদ উল্লাহ ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
বিএনপির নেতারা বলেন, জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, তারা নতুন করে আরেকটি ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চায়। তারা বলেন, শাহজাহান চৌধুরীর এ মন্তব্য শুধু দায়িত্বজ্ঞানহীনই নয়, বরং স্পষ্টতই ষড়যন্ত্রপ্রসূত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবপূর্ণ। তার এমন বক্তব্য নির্বাচনী পরিবেশকে অস্থিতিশীল ও উত্তেজনামূলক করে তোলার একটি সুস্পষ্ট অপচেষ্টা, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতির নীতি, আচার ও আদর্শের ওপর সরাসরি আঘাত হানে।
যৌথ বিবৃতিতে নেতারা উল্লেখ করেন, প্রশাসনের প্রতি প্রকাশ্য হুমকি, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণের ইঙ্গিত এবং জনগণের ভোটাধিকারকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে এমন বক্তব্য দেওয়া রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ বর্জিত আচরণের জঘন্য উদাহরণ। এটি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ধ্বংসের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত একটি অপতৎপরতারই অংশ। শাহজাহান চৌধুরীর ভাষায় যে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছে, তা অতীতের মানবতাবিরোধী অপশক্তির বর্বরতা ও দমননীতির করুণ স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
বিবৃতিতে নেতারা দৃঢ়ভাবে দাবি করেন, শাহজাহান চৌধুরীকে তার রাজনৈতিক শালীনতাবিরোধী, ঘৃণ্য, ষড়যন্ত্রপ্রসূত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবপূর্ণ বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এবং জনসম্মুখে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। একই সঙ্গে গণতন্ত্র, নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এ উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার কারণে শাহজাহান চৌধুরীকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
গতকাল চট্টগ্রাম মহানগর এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারী (দপ্তর) আরিফ মঈনুদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্যে পুলিশ-প্রশাসনকে নির্বাচনকালীন দলীয় লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করার নিন্দনীয় অভিপ্রায় পরিলক্ষিত হয়েছে। আমরা এ ধরনের ঘৃণ্য প্রচেষ্টার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে চাই, রাজনৈতিক ফায়দা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে কুক্ষিগত করে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করা আর চলবে না।
স্থানীয় জনসাধারণের অনেকের ভাষ্য, জামায়াতের একজন দায়িত্বশীল নেতার মুখে এমন বক্তব্য অশোভনীয়। তার এ বক্তব্য প্রতিহিংসামূলক। প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে তার কাছ থেকে এমন বক্তব্য কাম্য ছিল না।
এদিকে, শাহজাহান চৌধুরীর বক্তব্য নিজস্ব এবং এক্ষেত্রে জামায়াতের কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও চট্টগ্রামের জোনের প্রধান মুহাম্মদ শাহজাহান। গতকাল গণমাধ্যমকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এটা একান্তই উনার বক্তব্য। এটার ব্যাখ্যা উনি ভালো দিতে পারবেন। তার এ বক্তব্য জামায়াত সমর্থন করে না। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। এ ঘটনায় আমরা অভ্যন্তরীণভাবেও আমাদের মতো ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা মনে করি, প্রশাসন পূর্ণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। এখানে আমাদের হস্তক্ষেপের কিছু নেই। অতীতে প্রশাসনের যারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেননি, তারা দেশের ক্ষতি করেছেন।’
সূত্র : কালবেলা












































