প্রচ্ছদ সারাদেশ পেনশন আটকে থাকা সেই শিক্ষকের স্ত্রী মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়

পেনশন আটকে থাকা সেই শিক্ষকের স্ত্রী মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়

অবশেষে অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন পেনশনের টাকার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামের (৬৫) স্ত্রী তোহরা খাতুন (৪৫)।

বুধবার (১২ জুন) সকাল ১০টার দিকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হলে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক তোহরা খাতুনকে মৃত ঘোষণা করেন। শিক্ষক নজরুল ইসলাম নিজেই তার স্ত্রী তোহরা খাতুনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আ ফ ম রিয়াজ উদ্দিন মানিক শিক্ষক নজরুল ইসলামের স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আসলে স্যারের বিষয়টা যখন উনার ফেসবুকে উনি পোস্ট করে, তখন এক বন্ধু আমাকে মেনশন করে কিছু করা যায় কিনা। আমি তারপর সবার সঙ্গে যোগাযোগ করি, এমপি মহোদয়কেও জানাই। উনি ঈদের ছুটির পরে নিজেই স্যারের জন্য কাজ করবেন বলে জানান। এরই মধ্যে স্যারের সহধর্মিণী মারা গেলেন। আসলে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছি না। শুধু বলব এভাবে যেন আর কোনো শিক্ষক ভোগান্তির শিকার না হয়।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের উত্তর শ্রীরামপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৩৫ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি এমপিও দাখিল মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন। বছর চারেক আগে অবসরে যান এই শিক্ষক। শিক্ষক জীবনে তার হাতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়েছে। শিক্ষা দিয়ে তিনি অনেকের জীবনের পরিবর্তন ঘটালেও তার নিজের জীবন এখন চরম সংকটাপন্ন অবস্থায়। অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক অবসরে যাওয়ার পরে আজ পর্যন্ত পেনশনের টাকা পাচ্ছেন না। পেনশনের টাকা না পাওয়ায় চিকিৎসা বন্ধ হয়েছিল শিক্ষক নজরুল ইসলামের শয্যাশায়ী অসুস্থ স্ত্রী ও কন্যার। পেনশনের টাকার জন্য দারে দারে ঘুরতে হয়েছে এই মানুষ গড়ার কারিগরকে।

আরও পড়ুন: বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যুবককে কুপিয়ে হত্যা

শিক্ষক নজরুল ইসলামের দুই কক্ষ বিশিষ্ট অর্ধপাকা একটি টিনের ঘর রয়েছে। যার একটি কক্ষে তার অসুস্থ স্ত্রী তোহরা খাতুন (৪৫) অপর কক্ষে অসুস্থ মেয়ে রুমা খাতুন (২৬) শয্যাশায়ী। তার স্ত্রী তোহরা খাতুন ছয় মাস ধরে শরীরের মাংস পচন রোগে ভুগছিলেন। অপরদিকে মেয়ে রুমা খাতুন স্নাতক পাস করার পর গত চার বছর ধরে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী এবং মেয়ের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছোটাছুটি করতে হয় শিক্ষক নজরুলকে। আবার পেনশনের টাকার জন্য তাকে বার বার ধরনা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) প্রতিষ্ঠানে। অবশেষে পেনশনের টাকাও পেলেন না তিনি, অপরদিকে অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় হারালেন স্ত্রীকে।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম জানান, তিনি ১৯৮২ সাল থেকে শ্রীরামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে বাঘারপাড়ার এমপিওভুক্ত খানপুর দাখিল মাদরাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। সেখান থেকে গত ২০২০ সালের ২১ জুন অবসর গ্রহণ করেন শিক্ষক নজরুল। অবসরে যাওয়ার পর কল্যাণ তহবিলের ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পেলেও আজ পর্যন্ত পেনশনের একটি টাকাও পাননি তিনি।

তিনি বলেন, ‘অর্থের অভাবে আমার অসুস্থ স্ত্রী এবং মেয়ের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে আছে। তাদের প্রতি মাসে চিকিৎসা সেবার জন্য ১০-১৫ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়। তাদের চিকিৎসা করানো তো দূরের কথা তিনবেলা ভাতের ব্যবস্থা করার মতো সামর্থ্যও নেই আমার। বাঘারপাড়ার একটি এনজিওতে তিন হাজার টাকা বেতনে একটি চাকরি নিয়েছি। তাই দিয়ে আপাতত কোনো রকম ডালভাত খেয়ে বেঁচে আছি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুই ছেলে, তারা যে যার মতো আলাদা থাকে। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি নিজেও সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। আমার পরিবারে আমিসহ তিনজন সদস্য আমরা তিনজনই রোগী। পেনশনের টাকার জন্য কয়েকবার ঢাকার ব্যানবেইসে গিয়েছি। সেখান থেকে আমার কাগজপত্র অস্পষ্ট বলে ফিরিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষক নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ঢাকায় যাওয়ার মতো অর্থও আর আমার নেই। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমার কাগজপত্রগুলো পুরাতন হয়ে যাওয়ার ব্যান বেইস আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছে। আমি আকুতি মিনতি করলেও আমার পেনশনের টাকার কোনো ব্যবস্থা তারা করেনি। আমার প্রতি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি দেয়ার জন্য অনুরোধ করছি।

তিনি বলেন, আমার ছাত্র অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশবিদেশে চাকরি করছে। কেউ আজ পর্যন্ত আমার খোঁজখবর নেয়নি। সম্প্রতি আমি ফেসবুকে লাইভে এসে আমার জীবন দশার কথা বললে, অনেকে যোগাযোগ করেছে, সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু কেউ এখনো সহযোগিতা করেনি।

বন্দবিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও খানপুর দাখিল মাদরাসার সভাপতি মো. সবদুল হোসেন খান বলেন, আমাকে নজরুল স্যার কিছু জানায়নি, আর আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।

যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. মাহফুজুল হোসেন বলেন, এটা জেলা শিক্ষা অফিসের আওতায় না। মাদরাসার বিষয়গুলো উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দেখাশোনা করেন।

বাঘারপাড়া উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান বলেন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলামের বিষয়টি নিয়ে আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কিছুই করার নেই। এটা ওই মাদরাসার সভাপতির সই-সাক্ষরসহ ঢাকা কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করতে হবে।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।