দেশজুড়ে : খামারের শুয়োররা অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। তাদের যুক্তি- মানুষরা পশুর চেয়ে অধম। সুতরাং অধমের অধীনে উত্তমরা কিছুতেই বন্দী থাকতে পারে না। তারা দল বেঁধে সবচেয়ে বয়স্ক ও বুদ্ধিমান শুয়োরের কাছে গেল; যাকে খামারের সব পশু আদর করে বৃদ্ধ মেজর বলে ডাকত। বুদ্ধি-পরামর্শ শেষে দলনেতা বিদ্রোহের অনুমতি দিলো এবং কিভাবে রাজ্যের সব পশু খামারে বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে দেয়া যায়, সে ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করল।
বিদ্রোহের বাণী পৌঁছানোর দায়িত্ব দেয়া হলো কবুতর বাহিনীকে। তারা বৃদ্ধ মেজরের পয়গাম নিয়ে এক খামার থেকে অন্য খামারে ছুটতে থাকল। ফলে গরু-ঘোড়া-গাধা থেকে শুরু করে হাঁস-মুরগির খামারগুলোতে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ল। এই বিদ্রোহ কিভাবে সফল হলো তা যদি জানতে চান তবে আপনাকে বিশ্বসাহিত্যের অমর দিকপাল জর্জ অরওয়েল সৃষ্ট সর্বকালের সেরা সাহিত্যকর্ম ‘এনিমেল ফার্ম’ নামের উপন্যাসটি পড়তে হবে। আজকের আলোচনায় আমি পশু বিদ্রোহের সেই কল্পিত কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে বরং উপন্যাসটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে সাধ্যমতো বর্ণনার চেষ্টা করব।
এনিমেল ফার্ম উপন্যাসে কেন খামারের পশুরা বিদ্রোহ করল- এমন প্রশ্নের পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়, আর সেটি হলো, বনের পশুরা কেন করল না। আমার মতে, বনের পশুরা প্রকৃতিগতভাবেই স্বাধীন। কোনো মানুষের অধীনতা তারা করে না এবং তাদের বন্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- তারা জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রে শতভাগ স্বাধীন ও সার্বভৌম। উদাহরণ হিসেবে সুন্দরবনের বাঘ বা হরিণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। বনের বাঘ বাংলাদেশের বনমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে শিকারে বের হয় না। তার চলাফেরা, হাঁক-ডাক, আরাম-আয়েশের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অধিকন্তু সরকারের উঁচু গলাওয়ালা লোকজনকে বাঘমামার বাড়িতে বিশ্রামের জন্য পাঠানো হলে হাঁক-ডাকের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে যদি জর্জ অরওয়েল কোনো সাহিত্য রচনা করতেন সেটিও এনিমেল ফার্মের চেয়ে কম জনপ্রিয় হতো না।
বাঘের মতো হরিণরাও স্বাধীন। কোন দিন কোন হরিণ কোথায় ঘাস খাবে তা মন্ত্রী-এমপি-বনরক্ষীদের দয়ামায়ার বিষয় নয়। কোন হরিণ কোথায় থাকবে- কাকে বিয়েশাদি করবে এবং কখন মনের আনন্দে গান গাইবে অথবা তিড়িংবিড়িং করে লাফ মারবে তা সরকারের কোনো দফতর চেষ্টা করলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আবার যে হরিণটি বাঘের আক্রমণের শিকার হয় তার আত্মীয়স্বজন পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসার হেড কোয়ার্টারে এসে অভিযোগ দায়ের করে না। তারা পুলিশের আইজি বা র্যাবের ডিজিকে উদ্দেশ করে বলে না যে, আপনারা কেন আমাদের খোঁজখবর রাখেন না, কেন নিরাপত্তা দেন না। বনের স্বাধীন প্রাণীরা খাদ্যের জন্য মিছিল করে না- স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চৌদ্দগুষ্ঠী উদ্ধার করে না। তারা নিজেদের প্রয়োজনে নিজের স্বভাব ও যোগ্যতা অনুযায়ী যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু কাজ করে এবং সেভাবে নিজের প্রতি, পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। ফলে জঙ্গলের প্রাণীর যে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রয়েছে তা মনুষ্যসমাজে কল্পনাও করা যায় না। ফলে বনের পশুদেরকে নিয়ে তৈরি হয় টারজানের মতো উপন্যাস যেখানে মানবশিশু জানোয়ারের মাতৃস্নেহের আশ্রয়ে কৃতীমান পুরুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে অর্থাৎ স্বাধীন পশুরাও টারজানের মতো আকর্ষণীয় পুরুষ তৈরি করতে পারে। অন্য দিকে পরাধীন মানুষও পশুর জীবনচক্র কিভাবে চলতে থাকে তা এনিমেল ফার্ম উপন্যাসে জর্জ অরওয়েল এতটা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন, যার সাথে অন্য কোনো সাহিত্যকর্মের তুলনা চলে না।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সহজাত ব্যক্তিত্ব আচার আচরণ-দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি কিংবা আভিজাত্য ইত্যাদির কোনোটিই খোঁয়াড় কিংবা খামারের পশুদের মধ্যে থাকে না। খোঁয়াড়কে আপনি কারাগারের সাথে তুলনা করতে পারেন- আর খামারকে তুলনা করতে পারেন কোনো স্বৈরশাসকের অধীন পরিচালিত কোনো দেশ, জাতি কিংবা সমাজের সাথে। অন্য দিকে সার্কাসের পশুর সাথে আপনি তুলনা করতে পারেন কোনো দুর্বৃত্ত-নির্বোধ ও অসভ্য পাগলা রাজার রাজদরবার যেখানে আমির-ওমরাহ, পাইক-পেয়াদা সবাই সার্কাসের পশুদের মতো নিজ পরিচয় ভুলে মালিকের ইশারায় নৃত্য করতে থাকে। সুতরাং খামারে সেসব পশু লালিত-পালিত হয় তাদেরকে উপলক্ষ করেই জর্জ অরওয়েল তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মানবসমাজের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও দুরাচার নিয়ে কটাক্ষ করেছেন।
পশুদের খামার বলতে পশ্চিমা দুনিয়ায় যা রয়েছে তা আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশে সাধারণত যেসব পশুকে গৃহে লালন-পালন করা হয়, সেগুলোতে গৃহপালিত পশু বা পাখি বলা হয়। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মহিষ ছাড়াও এ দেশের মানুষ কুকুর, বিড়াল পালন করে। এ ছাড়া অনেকে কবুতর, টিয়া, ময়না, শালিক প্রভৃতি পাখি শখ করে অথবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে লালন-পালন করেন। কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ায় গরু-ছাগলের চেয়ে শুয়োরের চাহিদা বেশি থাকায় অন্য যেকোনো পশুর খামারের চেয়ে শুয়োরের খামার বেশি। শুয়োরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব, সংখ্যাধিক্য ও দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় শুয়োরের মাংসের জনপ্রিয়তার কারণে জর্জ অরওয়েল তার উপন্যাসে শুয়োরকে নেতা বা নায়ক বানিয়ে পুরো পশুসমাজের বিদ্রোহ ও বিপ্লবের নেতৃত্ব এই প্রাণীটির ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
এনিমেল ফার্মের শুয়োরের খামারের শুয়োর দল ও তাদের নেতার চরিত্রকে রূপক হিসেবে ধরে লেখক সমসাময়িক সমাজের দিকে যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তা নিবন্ধের শুরুতেই বলা হয়েছে। প্রাণিকুলের মধ্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, চেহারা, চরিত্র ও অভ্যাসের গুণগত দিকে বিবেচনা করলে শুয়োরের চেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণী দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পোষ মানানো, বংশবৃদ্ধি ও মোটাতাজা হয়ে মনুষ্যসমাজকে আমিষ ও চর্বি প্রদানের ক্ষেত্রে শুয়োরের বংশের সাথে অন্য কোনো পশুর বংশক্রমের তুলনা চলে না। অন্য দিকে পশু-পাখিদের সবার মধ্যেই অনুকরণীয় অনেক গুণাবলি রয়েছে, যেগুলো মনুষ্যসমাজে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিংহের গর্জন, বাঘের রাজকীয়তা, কুকুরের বিশ্বস্ততা, ঘোড়ার বুদ্ধি ও বিশ্বস্ততা, বিড়ালের আনুগত্য, গাধা-গরুর ধৈর্য ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হলেও শুয়োরের মধ্যে পাওয়া যায় এমন একটি গুণের কথা আজ অবধি বিশ্ববাসী জানতে পারেনি। অথচ সেই অসভ্য শুয়োরের দলের ওপরই লেখক পশু বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু কেনো!
আপনি যদি উল্লিখিত প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যান তবে বিদ্রোহী শুয়োর দলের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলেই তা পেয়ে যাবেন। খামারের শুয়োররা মনে করে যে, তারা মানুষের চেয়ে উত্তম বা শ্রেষ্ঠ; অর্থাৎ শুয়োরের দল যে মানবগোষ্ঠীর কথা বলছে অর্থাৎ বিভিন্ন পশু খামারের মালিকদের কথা বলছে; সেসব মানুষের অমানবিকতা-নৃশংসতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বিকৃত রুচি ইত্যাদি শুয়োরের দলের চেয়েও নিকৃষ্ট। ফলে পশুরা খুব সহজে তাদের খামার মালিকদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুত্ব ও তার আচরণগত পাশবিকতা টের পেয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর সব প্রাণীর মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, রাগ-ক্রোধ, কামনা-বাসনা রয়েছে এবং এগুলো চরিতার্থ করার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, দলাদলি করে; কিন্তু বিদ্রোহ করে না। বিদ্রোহ করার জন্য দুটো বৈশিষ্ট্য জরুরি। প্রথমত; স্বাধীন ও সার্বভৌমরা কোনো দিন বিদ্রোহ করে না। দ্বিতীয়ত; গৃহপালিত বা পোষ্যরাই বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহের সফলতার একমাত্র শর্ত হলো আত্মশক্তি। যার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হবে তার কুকর্ম করার ক্ষমতাকে চরিত্র মন-মানসিকতা ও শক্তিমত্তা দিয়ে চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার মতো শক্তি যদি বিদ্রোহীগোষ্ঠীর না থাকে তবে বিদ্রোহ পরাভূত হতে বাধ্য।
আমরা আজকের আলোচনার শেষপর্যায়ে চলে এসেছি। এই পর্যায়ে বলব, জর্জ অরওয়েল কেনো পশু বিদ্রোহের নেতৃত্ব গরু-ঘোড়া-গাধা-মুরগি-হাঁস-কবুতরদের না দিয়ে শুয়োরদের হাতে দিলেন। আপনি যদি এই প্রশ্নের জবাব আমার কাছে জানতে চান তবে আমাকে বলতে হবে যে, এনিমেল ফার্মের মালিকদের চরিত্র এমন নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যা গরু-গাধার বৈশিষ্ট্য দিয়ে মোকাবেলা সম্ভব নয়। ফলে খামারগুলোতে লালিত-পালিত পশুদের মধ্যে যাদের নিকৃষ্টতা, গুঁয়ার্তুমি, নোংরামি ও নৃশংসতা সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল, সেই শুয়োরের দলের ওপরই লেখকের আস্থা পয়দা হয়েছিল এবং শুয়োররা তাদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ, প্রবীণ ও যোগ্য শুয়োরটিকে নেতা বানিয়ে পশুবিদ্রোহে সফলতা লাভ করেছিল।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |