১. নাগরিক টিভির (পরবর্তীতে অন্য মিডিয়া) কল্যাণে সদ্য বিখ্যাত হয়ে ওটা বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের কথা বলার আগে বাংলাদেশের এক সাবেক সংসদ সদস্যের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিনা!
মালা খান- সরকারি অফিসে বিশেষ ‘রেস্ট রুম’ বানিয়ে আলোচনায়
২. বাংলাদেশে এক সময় একটি সংসদ ছিল। সেই সংসদের একজন এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-৩ আসনের স্বনির্বাচিত এ মহানায়কের নাম ছিল অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমেদ। ২০২০ সালে চাকরি প্রত্যাশী ৩৩ বছরের এক নারীর সাথে চাকরি দেবার কথা বলে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন । উনার সেই অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ফেসবুক এবং ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের (নির্বাচনী আসন) মানুষ তো বটেই, বাংলাদেশের সচেতন নাগরিকরা এ ঘটনা জেনে অবাক হন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থা নেয়নি। চিরাচরিত অভ্যাস অনুসারে এ মহানায়কের (!) অনুসারীরা ঘটনাটিকে স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেন। ২০২৩ সালে সংসদ ভেঙে দেয়ার আগে পুরো তিনটি বছর তিনি সংসদে বাংলাদেশের মানুষকে আইন এবং নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। সংসদে বসে একপর্যায়ে ইউটিউবকে বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাবও করেছিলেন। জাতীয় সংসদের একজন সদস্যের এ ধরনের প্রকাশ্য অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ইউটিউবে চলে আসার পরও সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অথবা বলা যায় এ মহানায়কের এতই ক্ষমতা ছিল যে সরকার তার ব্যাপারে কিছু করতে বা বলতে সাহস পায়নি!
অন্যভাবে বলতে গেলে এ ধরনের ব্যবহার সরকারের কাছে চিন্তার কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু আমরা চিন্তিত ছিলাম।
সাবেক এমপি নাজিম উদ্দিন- অবৈধ অনৈতিক নারী সম্পর্কের ভিডিও এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায়
৩. জামালপুরের তৎকালীন (২০১৯) ডিসি জনাব আহমেদ কবীরের কথা মনে আছে? সরকারি অফিসের সাথে লাগানো নিজস্ব ‘রেস্ট রুমে’ ওই অফিসের এক নারী সহকর্মীর সাথে উনার শারীরিক সম্পর্কের একটি ভিডিও প্রকাশ্যে চলে আসে। সারাদেশে তুমুল হইচই হয়। আহমেদ কবিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করে। তাকে প্রথমে ওএসডি করা হয়। পরবর্তীতে তথাকথিত শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। কী শাস্তি দেয়া হয়েছিল? মনে আছে আপনাদের? স্মরণ করিয়ে দেই- উনার পদ থেকে এক পদ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর সাথে বলা হয়েছিল যে তিনি আর কখনো পদোন্নতি পাবেন না। সরকারি অফিসে প্রকাশ্যে নারী সহকর্মীর সাথে বারবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে উনি যে অপরাধ করেছিলেন, তা কি বাংলাদেশের আইন অনুসারে ফৌজদারি (criminal offence) অপরাধ ছিল? যদি হয়ে থাকে তাহলে পুলিশ এবং আদালত এ ভদ্র লোকের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল? কিছুই নেয়নি। কেন নেয় নি? এই প্রশ্ন কি কখনো করা হয়েছিল? আমি করেছিলাম। কিন্তু আমার লেখাটি আর পত্রিকায় আসতে পারেনি।
৪. বাংলাদেশি কূটনীতিক কাজী আনারকলির ইন্দোনেশিয়ায় পুলিশ কর্তৃক আটক হবার ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে। গুরুতর অভিযোগ। ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি মুসলিম রাষ্ট্রে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত এক লোকের সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তার সাথে একসাথে থাকছেন। এ অনৈতিক সম্পর্ক ছাড়াও তিনি মাদক গ্রহণের সাথে জড়িয়ে যান। ইন্দোনেশিয়া পুলিশ তার বাসায় গাঁজা রাখা এবং সেবনের প্রমাণ পায়। তাঁকে আটক করে মাদক নিয়ন্ত্রণ ডিটেনশন সেন্টারে ২৪ ঘণ্টা রাখা হয়। বিশেষ কূটনৈতিক প্রটেকশন থাকার কারণে ইন্দোনেশিয়া সরকার তার বিরুদ্ধে আর অ্যাকশনে যায়নি। মহিয়সী(!) এ নারী কাজী আনারকলিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশে ডেকে পাঠায়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবস্থায় এই কূটনীতিক গৃহকর্মী নিখোঁজের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। বাংলাদেশ সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেয়নি, বরঞ্চ তড়িঘড়ি করে তাকে ওখান থেকে সরিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় পোস্টিং দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয় কাজী আনারকলির বিরুদ্ধে অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত করা হয়েছিল? তদন্তে কি কিছু পেয়েছিলেন আপনারা? নাকি উনার বিরুদ্ধেও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্র করেছিল? আমার মতো অনেকেই জানতে চাইবেন, কাজী আনারকলির ব্যাপারে সরকারের প্রশাসনিক ও ফৌজদারি কার্যবিধির কোনো ধারা লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল? বিদেশি মিশনে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর ধরন দেখুন-গৃহকর্মী অপহরণ, মাদক দ্রব্য সেবন এবং বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।
কাজী আনারকলি- মাদক সেবন ও বিবাহবহির্ভুত সম্পর্ক রাখার অভিযোগ
৫. আমার দৃষ্টিতে এমপি নাজিম উদ্দিন আহমদ, ডিসি আহমেদ কবির ও কূটনীতিক কাজী আনারকলি বিভাগীয় এবং ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়েছেন। ডিসি আহমেদ কবিরের বিরুদ্ধে কুসুম কুসুম প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ফৌজদারি অপরাধের ব্যাপারে কোনো অ্যাকশন নেয়া হয়নি। বাকি দুই মহান ব্যক্তির ব্যাপারে প্রশাসনিক এবং ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে এখনো ব্যবস্থা নেয়ার কোনো খবর বা প্রমাণ নেই। খেয়াল করে দেখুন, এই তিন বিশেষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিবাহবহির্ভূত অপরাধের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৬. গত সপ্তাহে Bangladesh Reference Institute for Chemical Measurements (BRICM) এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মালা খানের অফিসে ব্যক্তিগত বিশেষ কক্ষ নিয়ে যে খবর এবং ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে এটি স্পষ্ট যে, মালা খান এবং একই প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা রবীন্দ্রনাথ রায়ের দুই কক্ষের মাঝখানে গোপন পথে প্রবেশের পর যে রুম পাওয়া গেছে সেই রুম কোনোভাবেই তাদের ডিউটির সঙ্গে জড়িত নয়। বিশেষ রুমে বিছানা বালিশসহ আরও এমন কিছু গোপন এবং একান্তই ব্যক্তিগত জিনিস পাওয়া গেছে যা শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী একান্তে ব্যবহার করেন। জিনিসগুলো গোপনপক্ষে কেন রাখা হয়েছিল? উনারা তো স্বামী স্ত্রী নন, তাহলে ব্যক্তিগত জিনিসগুলো কার এবং কেন? প্রতিষ্ঠানের বাকি কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা মালা খান এবং রবীন্দ্রনাথ রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করছেন তা এক কথায় ভয়াবহ।
৭. বলা হচ্ছে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। এসব বড় বড় কথা বাংলাদেশে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে প্রায় শোনা যায়। আসলেই কি কথাটি সত্য? যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এমপি, ডিসি, কূটনীতিক এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা যেসব ফৌজদারী অপরাধে জড়িয়েছেন তার ব্যাপারে কেন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? একই অপরাধ যদি সাধারণ কোনো নাগরিক করে থাকেন, রাষ্ট্র কি তার ব্যাপারেও একইভাবে নীরব থাকবে?
৮. Professional misconduct হলে সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুসারে সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও উপরের ঘটনাগুলোতে এর ব্যত্যয় প্রকাশ্য। আর বিবাহবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা যদি অপরাধই হয়ে থাকে (অবশ্যই অপরাধ) তাহলে কেন পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি? পুলিশ ব্যবস্থা না নিলেও আদালত কেন নীরব থাকলেন?
৯. বাতাসের গতি এখন বদলেছে। সরকারি চাকরিতে ঢুকে যা ইচ্ছা তা করার ভূতকে বোতল বন্দি করার এখনই মোক্ষম সময়। আর যদি এই ভূতগুলোকে বোতল বন্দি না করতে পারেন, তাহলে ‘আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান’ কথা বলা বন্ধ করুন। যদি সাবেক এমপি নাজিম উদ্দিন আহমদ, ডিসি আহমেদ কবির বা কূটনীতিক আনারকলিকে ভালোভাবে বোতলে বন্দি করতে পারতেন, তাহলে হয়তো আজকে মালা খান এবং রবীন্দ্রনাথ রায়ের কাহিনী আমাদের শুনতে হতো না।
সূত্র : মানবজমিন
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |