প্রচ্ছদ জাতীয় দুই সফলতাকে পুঁজি করে আরও দুই সফলতা ঘরে তুলতে চায় শিবির

দুই সফলতাকে পুঁজি করে আরও দুই সফলতা ঘরে তুলতে চায় শিবির

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে বিজয়ের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে সংগঠনটির সমর্থিত প্যানেল। বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কল্যাণমূলক রাজনীতি, সামাজিক সংগঠন হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে নিজেদের তুলে ধরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখাই এমন জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। আসন্ন রাকসু ও চাকসুতেও শিবির সমর্থিত প্যানেলের জয়ের সম্ভাবনা দেখছেন তারা। ছাত্রশিবিরও বলছে, ডাকসু ও জাকসুর সাফল্য তারা রাকসু ও চাকসুতেও ধরে রাখতে চায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আসল প্রয়োজন ও অধিকারকে এতদিন কোনো সংগঠনই গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু গত এক বছরে ইসলামী ছাত্রশিবির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা কী চায়, কী ধরনের সেবা প্রয়োজন—এগুলো তারা প্রচার ও কার্যক্রমে তুলে ধরেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে তারা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক সংগঠন হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে।

এ ছাড়া মূল দলের লেজুড়বৃত্তি করা, চাঁদাবাজি করা—এসবেও তারা ছিল না। অন্যান্য সংগঠন কিন্তু এই দোষে দুষ্ট। শিক্ষার্থীদের কাছে এই ইতিবাচক ভাবমূর্তিই তাদের বড় ধরনের জয় এনে দিয়েছে। জাকসুর মতো রাজশাহী ও চট্টগ্রামেও শিবিরের সাফল্য ধরা দেবে বলে আমার ধারণা।’

গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে বিশাল জয় পায় ছাত্রশিবির। নির্বাচনে তাদের প্যানেলের নাম ছিল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’। এই প্যানেলের প্রার্থীরা ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জিতেছেন। শীর্ষ তিন পদের পাশাপাশি ডাকসুর ১২টি সম্পাদকীয় পদের ৯টিতেই জিতেছেন শিবির-সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। ডাকসুর ১৩টি সদস্য পদের মধ্যে শিবিরের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন ১১টিতে। এ ছাড়া গতকাল শনিবার ঘোষিত জাকসু নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলে কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫ পদের ২০টিতেই ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল জয়ী হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলো যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে বেছে নিয়েছিল, তখন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড কর্মকাণ্ড ও কল্যাণমূলক রাজনীতিকেই তাদের রাজনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটিই শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেছে। গত এক বছরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছেছে। এ ছাড়া শিবিরের নেতাকর্মীদের দলীয় কোন্দল, সংঘাত, চাঁদাবাজি, মারামারিসহ অনৈতিক কাজগুলোতে না জড়ানোও শিক্ষার্থীদের পছন্দের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ছাত্রশিবির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সামাজিক আন্দোলনের মতো করে কাজ করেছে। শিবিরের ছেলেমেয়েরা নানামুখী পড়াশোনা করে, তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ারে সাফল্য ঈর্ষণীয়, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে। তাদের বেশিরভাগেরই আচরণ ভালো। তাই শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রশিবিরের প্রতি ‘পজিটিভ ইমেজ’ তৈরি হয়েছে। হলগুলোতে প্রকাশ্যে রাজনীতি কিংবা কমিটি না দিয়েও তারা কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে নানান কাজে সম্পৃক্ত থাকে। রাজনৈতিক পরিচয় সামনে না এনে হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নানা কার্যক্রমে যুক্ত থেকেছে তারা। মেয়েদের হলগুলোতেও তারা বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম চালায়। ফলে এবার ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা মেয়েদের প্রচুর ভোট পেয়েছেন, যা তাদের অভাবনীয় জয়কে ত্বরান্বিত করেছে।

শিবিরের সাংগঠনিক কাঠামোও নির্বাচনে অন্যদের চেয়ে তাদের এগিয়ে রেখেছিল। ক্যাম্পাসে গত এক বছর প্রকাশ্যে রাজনীতি করলেও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যায়নি। এ ছাড়া ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে নবনির্বাচিত ভিপি সাদিক কায়েমকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যের নায়ক হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা নানাভাবে করে গেছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরায় ‘জুলাইয়ের ৩৬ দিন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র সংগঠক হিসেবে সাদিককে আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়।

ডাকসু এবং জাকসুতে শিবিরের বড় জয়ের পেছনে আরেকটি কারণ নিজেদের সাংগঠনিক বলয়ের বাইরে সংগঠনটি তাদের প্যানেল ইনক্লুসিভ বা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ করার চেষ্টা করেছে। তাদের প্যানেলে ছিল একাধিক নারী, সংখ্যালঘু শিক্ষার্থী, জুলাই অভ্যুত্থানে চোখ হারানো শিক্ষার্থী, ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী, যা শিক্ষার্থীরা পছন্দ করেছে।

বিশাল এই জয়ের বিষয়ে শিবিরের নেতাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে তাদের চরম নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরও তাদের নিয়ে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা চালানো হয়েছে। কিন্তু শিবির সাংগঠনিকভাবে এসবের জবাব না দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। শিক্ষার্থীদের সুখে-দুঃখে সব সময় শিবিরের নেতাকর্মীরা পাশে থেকেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধরে রেখে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন অনুযায়ী তারা রাজনীতি করেছেন।

ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, গত এক বছরে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ‘ট্যাগিংয়ের’ পুরোনো রাজনীতিই করেছে। যারা শিবিরের রাজনীতি করে না তাদেরও শিবির বলে ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। এটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে পছন্দ করেননি। ধারাবাহিকভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছি। তাদের পেশিশক্তিমুক্ত, গেস্টরুম-গণরুমমুক্ত একটি সুন্দর ক্যাম্পাসের স্বপ্ন দেখিয়েছি। সবার সঙ্গে যুক্ততা, সক্ষমতা, ব্যক্তিত্ব, সবার কাছে যাওয়া, কথা শোনা—সব মিলিয়েই শিক্ষার্থীরা আমাদের বেছে নিয়েছেন। আমাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের নেতিবাচক ন্যারেটিভ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু আমরা দমে যাইনি। আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে গিয়েছি, যার ফল আজকের বিজয়। ছাত্রশিবির এই সাফল্য ধরে রাখতে চায়।

ডাকসুর সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, শিবিরকে যারা ভোট দিয়েছেন তারা যে সবাই শিবিরের আদর্শ-চিন্তা করে ভোট দিয়েছেন তা নয়, তারা ক্যাম্পাসে দখলদারির ছাত্ররাজনীতির আশঙ্কা থেকে ভোট দিয়েছেন। কারণ তারা অতীতে অনেক ছাত্র সংগঠনের দখলদারিত্বের রাজনীতি দেখেছেন, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বিবেচনায় শিবিরের রেকর্ড নেই। আর ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তাদের বড় একটা ভূমিকা ছিল। এ ছাড়া শিবিরের বিরুদ্ধে যে ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল, তাদের পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব ছিল—এটাও শিবিরকে সুযোগ করে দিয়েছে।

বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানার মতে, দীর্ঘদিনের কৌশল ও সুসংগঠিত কর্মকাণ্ডের কারণেই শিবির বিজয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, শিবির অনেকদিন ধরেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করছে। স্টুডেন্টদের সুখে-দুঃখে তারা ছিল। ওয়েলফেয়ার পলিটিক্সের অংশ হিসেবে হলে হলে ওয়াটার পিউরিফায়ার স্থাপন, আর্থিকভাবে অক্ষম শিক্ষার্থীদের কম খরচে বা বিনা খরচে কোচিংয়ের সুযোগ—এসব তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতিরই ফল। এটা তাদের গুপ্ত রাজনীতির প্রকাশ্য ফসলও বলতে পারেন। কিংবা তারা যে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিটাকে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে করতে পেরেছে, এটা তাদের একটা সফলতাও আপনি বলতে পারেন।
সূত্র: কালবেলা