অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য একসময় বাংলাদেশকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। এখন দেশের অর্থনীতি একটি অনিশ্চিত গতিপথের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি দারিদ্র্য বিমোচনে কঠোরভাবে অর্জিত লাভগুলোকে ফিরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। প্রত্যাশার তুলনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, চলতি দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে রেকর্ড করা ৭ শতাংশ থেকে উল্লেখযোগ্য পতন। মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। শিল্প উৎপাদন ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১০ শতাংশ। একইভাবে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে পরিষেবা খাত ৩ দশমিক ০৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এক বছর আগের বৃদ্ধির হারের অর্ধেকেরও কম। এই দুটি খাত একসঙ্গে দেশের মোট অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি।
এই মন্থর কর্মক্ষমতার কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তার পূর্বাভাস ৫ দশমিক ৭ শতাংশে সংশোধন করতে বাধ্য করেছে। এ পূর্বাভাস আগে বাংলাদেশের জন্য ছিল ৬ শতাংশ।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো অর্থনীতিবিদরা উদ্বিগ্ন যে, নিম্ন প্রবৃদ্ধির অর্থ কম চাকরি এবং কম আয়ের সুযোগ। প্রবৃদ্ধির জন্য আমাদের বিনিয়োগের প্রয়োজন এবং বিনিয়োগকারীদের পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের কারণে আমরা তা করতে পারছি না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দারিদ্র্যের মধ্যে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি উচ্চ সম্ভাবনা এবং আয় ও ভোগে বৈষম্য আরো গভীর হচ্ছে।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আইএমএফ সংশোধন নিয়ে শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, সরকারের গৃহীত সংস্কারগুলো ফল দিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। দারিদ্র্যের মাত্রা ২০০৬ সালে ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির পর অর্থনীতি আবার চালু হওয়ার পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরর পরিসংখ্যান অনুসারে, রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ অবস্থা থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মূল্যস্ফীতির উচ্চহার মানুষকে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের গোষ্ঠীর চাহিদা এবং ব্যবহারকে মারাত্মকভাবে মন্থর করেছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশিদ মনে করেন, প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশে খরচ চলে রফতানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং অর্থ সঞ্চালন দ্বারা। রফতানি ও রেমিট্যান্স স্থিতিশীল থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলার প্রচেষ্টার ফলে অর্থের প্রচলন কমে গেছে।
তিনি আরো বলেন, দুর্নীতি এবং দুর্বল নিয়ন্ত্রণ বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মূল কারণ, যা ব্যবসাকে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। যখন দুর্নীতি বা অনথিভুক্ত কাজ থেকে প্রচুর অর্থ ভাসমান থাকে, তখন এটি পুঁজির উড্ডয়ন ঘটায় এবং ডলারের অভ্যন্তরীণ প্রবাহ হ্রাস করে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী পর্যবেক্ষণ সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির মতে, ২০০৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অবৈধ বহিঃপ্রবাহের মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে গড়ে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার হারায়। বাংলাদেশও তার সমস্ত রফতানি রসিদ পায় না, কারণ বাণিজ্যের ভুল চালানের মাধ্যমে বছরে বিলিয়ন ডলার পাচার হয়।
২০২০ সালের প্রথম দিকে মহামারি আঘাত হানার আগে, পোশাক রফতানি, কৃষি এবং সেতু, রাস্তা এবং মহাসড়কের মতো অবকাঠামোতে বিশাল সরকারি বিনিয়োগ দ্বারা জ্বালানিতে বাংলাদেশ গড়ে ৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংক এটিকে ‘একটি মহান উন্নয়নের গল্প’ বলে অভিহিত করেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, অর্থনীতিতে বেশ কিছু কাঠামোগত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই বৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকেতার টানা তিন মেয়াদে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অংশ বাড়ায়নি। ১৩-১৪ বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ২৩ শতাংশে রয়ে গেছে। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ জিডিপির ২ শতাংশের নিচে রয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মামুন রশিদ বলেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো এখনো বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে। এ কারণেই বাংলাদেশ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বহুপাক্ষিক সাহায্যের ওপর ভরসা করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, বিদেশে কর্মরত ৬০ লাখ বাংলাদেশির কাছ থেকে রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি আরো বাড়াতে পারে। সূত্র: গ্লোবাল সিকিউরিটি
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |