প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক ট্রাম্পের নীতি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে বাংলাদেশের জন্য

ট্রাম্পের নীতি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে বাংলাদেশের জন্য

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল। ক্ষমতাসীন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পছন্দগুলোর জোরালো পরিবর্তনের প্রতিফলন। এগুলোর মূলে নবায়নকৃত রিপাবলিকান নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক প্রভাবের পাশাপাশি অর্থনৈতিক হতাশা, অভিবাসন ঘিরে উদ্বেগ ও জাতিগত সমীকরণও ছিল। ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের নতুন করে আবেদনের জোরালো কারণ এবং দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাবগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার ও বিদেশে এর কৌশলগত বিন্যাসের মধ্যে গভীর আন্তঃসম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পকে পুনর্বহাল করতে আমেরিকান ভোটারদের সিদ্ধান্তটি এসেছে ব্যাপক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে। মূল্যস্ফীতি বাড়াবাড়ি মাত্রায় বেশি। চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। এর বিপরীতে স্থানীয় কর্মসংস্থান জোরদার এবং বিদেশি শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী অ্যাজেন্ডা উদ্বিগ্ন ভোটারদের অনুরণিত করেছে।

‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতির প্রতি নতুন করে অঙ্গীকার এবং অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান সীমান্তে কড়াকড়িপ্রত্যাশী ভোটারদের মধ্যে ভালো সাড়া ফেলেছে।

অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনী দৌড়ে গত জুলাইয়ে কমলা হ্যারিসের আসার বিষয়টি ছিল প্রত্যাশিত সময়ের চেয়েও দেরিতে। তিনি একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী। এসব কারণে মূল ভোটারদের মধ্যে কমলার ব্যাপারে আবেদন থাকতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বৈরিতা মূলত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছে। সেখানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্ক ‘হাউডি, মোদি!’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’-এর মতো উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হয়েছে।

এগুলো ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের সম্ভাব্য ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে। এই সম্পর্ক সম্ভবত মোদির সরকারকে শক্তিশালী করবে। এটি চীনের প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের অংশ হিসেবে এই অঞ্চলে ভারতকে আরো প্রভাব খাটাতে ও স্বাধীনভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ দিতে পারে।

ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী নীতি বা কৌশলগুলো প্রায়ই বিশ্ববাণিজ্য ও বৈদেশিক সম্পৃক্ততায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে পরিবর্তন করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টি আমেরিকানদের চাকরি ও উৎপাদন খাতের সুবিধা নিশ্চিত করা। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুস্পষ্ট লাভ না হলে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য বাণিজ্য সুবিধা কমতে পারে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর তাদের নির্ভরতা পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মতো যারা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল। উপরন্তু, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে প্রতিরক্ষা দপ্তরের অব্যাহত ভূমিকা, দক্ষিণ এশিয়ায় সুনির্দিষ্টভাবে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করার আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে তাঁরা একটি পরিবর্তনশীল সময়ে প্রবেশ করেছেন। ক্লিনটন, ওবামাসহ ডেমোক্র্যাট নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার জন্য পরিচিত ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের সময় তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জিং মনে করতে পারেন। ট্রাম্প প্রশাসন এই অঞ্চলে মানবাধিকার ও জলবায়ু সুশাসন ইস্যুতে খুব বেছে বেছে প্রভাব খাটায়। বাইডেনসহ ডেমোক্র্যাট প্রশাসনগুলো জলবায়ুবিষয়ক উদ্যোগ ও মানবাধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এ দুটিই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন জলবায়ু ও মানবাধিকারকে ততটা অগ্রাধিকার না দিয়ে লেনদেনমুখী কূটনীতি অনুসরণ করতে পারে। এতে ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক মিত্র কমতে পারে।

ড. ইউনূসের কার্যালয় নিশ্চিত করেছে যে কয়েকজন রিপাবলিকানের সঙ্গে তাঁর ইতিবাচক সম্পর্ক আছে। তবে অন্য রিপাবলিকানদের চেয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি ও অগ্রাধিকার আলাদা—এ বিষয়টিও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পক্ষপাতদুষ্ট বিভাজন সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রশাসনের মধ্যে সাদৃশ্য বজায় রেখেছে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত মৈত্রীর মাধ্যমে চীনকে মোকাবেলা করার ওপর দুই দলেরই জোর দেওয়া একটি ঐক্যবদ্ধ ধারা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য এর অর্থ হলো, ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বদলাতে পারে। তবে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক অবস্থান সম্ভবত অপরিবর্তিত থাকবে। ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে ভারতের ভূমিকা সম্ভবত ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সৃষ্টিতে মোদি সরকার আরো স্বাধীনতা পাবে।

ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোতে ভারতের অবস্থান আরো শক্তিশালী করবে। সীমান্ত নিরাপত্তা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব মোকাবেলায় মুখ্য বিষয় হিসেবে কাজ করবে।

ভারত ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে দৃঢ় পদক্ষেপসহ আঞ্চলিক এজেন্ডা অনুসরণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কম চাপ অনুভব করতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন মিত্র হিসেবে কোয়াডে ভূমিকার মাধ্যমে ভারতের ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক দৃঢ়তা মধ্যম থেকে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। যদিও তাৎক্ষণিক প্রভাব সীমিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী প্রশাসন এই পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে কতটা নিখুঁতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে তা দেখার বিষয়।

ট্রাম্পের লেনদেনভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিতে জলবায়ু ইস্যু সম্ভবত পিছিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বিস্তৃত উপকূলরেখার বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু ইস্যুতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে আরো বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

জলবায়ু চুক্তির বিষয়ে ট্রাম্পের ঐতিহাসিক অবস্থান, বিশেষ করে তাঁর প্রথম মেয়াদে প্যারিস চুক্তি থেকে প্রত্যাহার, বৈশ্বিক জলবায়ু উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কমানোর ধারাবাহিকতা জরুরি জলবায়ু অভিযোজন চাহিদা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারে। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্র্যাটদের অগ্রাধিকার। ট্রাম্পের এজেন্ডায় এটি গুরুত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এতে বাংলাদেশের উপকূলীয় সম্প্রদায়গুলোর ঝুঁকি বাড়বে।

ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন আমেরিকান সুরক্ষাবাদ এবং লক্ষ্যযুক্ত জোটের ওপর জোর দিয়ে পরিচিত নীতিগুলোর দিকে ঝোঁকার একটি ইঙ্গিত দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ককে শক্তিশালী করা এবং চীনের প্রভাবকে ভারসাম্যপূর্ণ করা ঘিরে আবর্তিত হবে। বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি নতুন পর্যায়। পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশে সাবধানে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগকারী হিসেবে থাকলেও জলবায়ু ও মানবাধিকার ইস্যুতে সমর্থন-সহযোগিতা কমতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে যে-ই থাকুক না কেন, তাকে বিবর্তিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মধ্যে দেশের জলবায়ু ও অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো সুরক্ষিত করতে এই সূক্ষ্ম প্রেক্ষাপটে কাজ করতে হবে।

রুদাবেহ্ শহীদ : আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া সেন্টারের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।