
জুলাই বিপ্লব নিয়ে ইয়েনি সাফাককে (তুরস্কের গণমাধ্যম) একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জুলাই বিপ্লবের নেতা সাদিক কায়েম। তিনি ব্যাখ্যা করছেন, কীভাবে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে কৌশলগতভাবে সংগঠিত করে এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত করে।
শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো এই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ্য সংগঠক সাদিম কায়েম একান্ত সাক্ষাৎকারে ইয়েনি সাফাককে জানিয়েছেন, কীভাবে একটি ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় জাতীয় বিপ্লবে। এই বিস্তৃত আলাপচারিতায় তিনি তুলে ধরেন আন্দোলনের সূচনা, পর্দার আড়ালে চলা সমন্বয় প্রচেষ্টা, গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ও তার চোখে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রূপরেখা।
ইয়েনি সাফাক: জুলাই আন্দোলনের পেছনের মূল প্রেরণা কী ছিল? কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আপনি ব্যাখ্যা করবেন?
সাদিম কায়েম: জুলাই আন্দোলনের মূল প্রেরণা নিহিত ছিল বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের অভিজ্ঞতায়। এই সময়ে রাষ্ট্র মদতপুষ্ট বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, নির্বাচনী জালিয়াতি, সংগঠিত ইসলামবিদ্বেষ ও মানবাধিকারের প্রতি নির্লজ্জ অবহেলা চালিয়ে গেছে।
২০১৩ সালে এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, যখন আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী প্রায় ২০০ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। একই বছরের ৫ মে, শাপলা চত্বরে আমরা প্রত্যক্ষ করি কীভাবে নিরীহ মাদ্রাসা ছাত্র ও আলেমদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়।
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উপর চালানো হয় হিংস্র দমন অভিযান, যার ফলেও বহু তরুণ প্রাণ হারায়।
২০২৪ সালের ৫ জুন শেখ হাসিনা আকস্মিকভাবে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করেন—যা সরকার সমর্থকদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ সৃষ্টি করে এবং হাসিনার অবৈধ শাসনকে বৈধতা দেওয়ার এক কৌশল হিসেবে দেখেছিল সবাই। এটি ছিল সহ্যের সীমার শেষ বিন্দু। এই ব্যবস্থাটি মেধার প্রতি অবিচার এবং সেই ক্ষোভই বিস্ফোরণে রূপ নেয়, যা ক্রমে একটি সর্বব্যাপী ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। জীবনের সকল স্তরের মানুষ তখন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
ইয়েনি সাফাক: বাংলাদেশে যখন গণমাধ্যম কঠোর নিয়ন্ত্রণে, বিশেষ করে ইন্টারনেট বন্ধের মতো পরিস্থিতিতে প্রতিবাদকারীরা সংগঠিত থেকে কীভাবে যোগাযোগ চালিয়ে গেছেন?
সাদিম কায়েম: সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম যখন প্রোপাগান্ডার যন্ত্রে পরিণত হয়, তখন সামাজিক মাধ্যমই হয়ে ওঠে আমাদের প্রধান হাতিয়ার। ৫ জুন, কোটা পুনর্বহালের দিনই আমরা ‘কোটা পুনর্বহাল চলবে না’ নামক ফেসবুক গ্রুপ চালু করি। এটি দ্রুতই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে, যেখান থেকে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়।
আমরা প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন করে মডারেটর নিযুক্ত করি যিনি সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসের যাবতীয় তথ্য, কর্মসূচি ও সংবাদ সমন্বয় করতেন।
১৮ জুলাই রাতে যখন পুরোপুরি ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০ জুলাই দেশজুড়ে কারফিউ জারি হয় আমরা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত ছিলাম। আমরা আগে থেকেই অতিরিক্ত সিমকার্ড ও বাটন ফোন সংগ্রহ করতে বলেছিলাম, যাতে অফলাইন যোগাযোগ বজায় রাখা যায়। ফলে প্রতিদিন বিকাল ৩টার মধ্যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়—প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদদাতাদের কাছে সরবরাহ করতাম।
আমাদের ৯ দফা দাবি ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ভিডিও প্রমাণ আমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাঠাই, কারণ স্থানীয় মিডিয়াগুলো তখন গোয়েন্দা সংস্থার দমনচক্রে কার্যত নীরব হয়ে যায়।
১৫ জুলাই নারীদের উপর নির্মম হামলার পর আন্দোলন এক নতুন গতি পায়। নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ আমাদের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এরপর ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে কিছুটা মনোবল ভেঙে পড়ে, কিন্তু ১৮ জুলাই থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব নেয়। পরে কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররাও সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হয়। শুধু যাত্রাবাড়িতেই একশ’র বেশি মানুষ শহীদ হন।
১৫ জুলাইয়ের নারীদের রক্তাক্ত ছবি সাধারণ মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দেয়—এটি ছিল এক মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত, যা বস্তিবাসী ও শহুরে মধ্যবিত্তদের মধ্যে সমানভাবে প্রভাব ফেলেছিল। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিভাজন পেরিয়ে একটি ঐক্য গড়ে ওঠে, যা বাংলাদেশে নজিরবিহীন।
ইয়েনি সাফাক: এই বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলো কোনগুলো ছিল? কীভাবে চাপ মোকাবিলা করেছেন?
সাদিম কায়েম: ১৮ জুলাইয়ের পর দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারফিউ এবং একের পর এক হত্যার ঘটনায় ভয় ও হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে পুরো আন্দোলনের সমন্বয় দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে। আমি প্রতিদিনের কর্মসূচি, বিবৃতি ও নেতাদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করি।
নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও মাহফুজ আলম এই সময়কার মূল কৌশলগত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এস এম ফারহাদ, মোহিউদ্দিন খান, মনজুরুল ইসলাম, সিবগাতুল্লাহ ও রিফাতসহ অনেকেই নিরন্তর কাজ করে যান মাঠে ও আড়ালে। ড. মির্জা গালিব ছিলেন পুরো বিপ্লব জুড়ে কৌশলগত নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ মেধাস্রোত।
আন্তর্জাতিক যোগাযোগে জুলকারনাইন সায়ের (আল-জাজিরা), সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন এবং পিনাকি ভট্টাচার্য অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। দেশীয় মিডিয়া স্তব্ধ থাকলেও তারা তথ্য পৌঁছে দেন প্রবাসী ও বৈদেশিক মহলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সাংবাদিক, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা) ও মোবাইল সাংবাদিকেরা মাটির কাছাকাছি থেকে রিপোর্ট করে তথ্যপ্রবাহ জাগিয়ে রাখেন।
চরমতম পরীক্ষাটি ছিল মনোবল ধরে রাখা। প্রতিদিন শতাধিক শহীদ হচ্ছেন, বহু সমন্বয়ক গ্রেফতার ও নির্যাতিত হচ্ছেন। ২৮ জুলাই রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে কিছু নেতাকে দিয়ে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণাও করানো হয়। আমরা তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাখ্যান করি এবং বলি—শেখ হাসিনা অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে ৪ আগস্ট, যখন ‘নতুন বাংলাদেশ’ নির্মাণের ৯ দফা দাবি ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা একত্রিত করে চূড়ান্ত দাবি নির্ধারিত হয়—শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আমি বুঝতে পারি, ৫ আগস্ট শাহবাগে দুপুর ২টায় বিক্ষোভ ডাকলে আওয়ামী লীগ আগে জায়গাটি দখল নিতে পারে। তাই আমি সকাল ১০টায় শুরু করার প্রস্তাব দিই এবং শেষ পর্যন্ত সেটিই বাস্তবায়িত হয়।
ঢাকাকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে একযোগে বিক্ষোভের সিদ্ধান্তই আন্দোলনের গতি নির্ধারণ করে দেয়। পরদিন ৫ আগস্ট ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ আক্রমণ চালানো হয় আন্দোলনকারীদের উপর। কিন্তু এই দমনই জনগণের প্রতিরোধ মনোভাব আরও দৃঢ় করে এবং হাসিনার পতনের ভিত্তি তৈরি হয়।
এ সময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আবদুল কাদের, হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার, রিফাত রাশিদ এগিয়ে আসেন।
আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নেতৃত্বের কাঠামোকে সংহত ও নির্ভরযোগ্য রেখেছি—চিহ্নিত ছাত্রনেতাদের বাইরে রেখে অভ্যন্তরীণ কৌশলগত নেতৃত্ব গড়ে তুলেছি। তাতেই আমরা সংগঠনের ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছি। ক্যাম্পাসের স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্রদের আমরা সাহস জুগিয়েছি, কিন্তু কৌশলগতভাবে নির্দেশনা দিয়েছি পেছন থেকে।
ইয়েনি সাফাক: সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং ভারত ও চীনের মতো বিদেশি শক্তির প্রভাব আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন? ভবিষ্যতের কূটনীতি নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
সাদিম কায়েম: আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র কর্মকর্তার পক্ষ থেকে সহানুভূতির ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি। তারা বিপ্লবের আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। যদিও সিনিয়রদের অনেকেই আগের শাসনের সুবিধাভোগী ছিলেন, কিন্তু নতুন প্রজন্ম রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সেতুবন্ধন রচনায় আগ্রহী।
আমরা স্পষ্ট করে দিতে চাই—যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গণহত্যায় জড়িত ছিলেন—তাদের রাজনীতিতে স্থান নেই যতক্ষণ না তারা বিচারের মুখোমুখি হন।
আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী দল—জার্মানির চরমপন্থি সংগঠনের মতোই তাদের স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।
ভারত গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশকে একপ্রকার উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা শুধু হাসিনার শাসন সমর্থনই করেনি, বরং ৫ আগস্টের গণহত্যাকেও নীরব সম্মতি দিয়েছে। তারা ভারতের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে—এই দিক থেকে তারা দক্ষিণ এশিয়ার ইসরাইলে পরিণত হয়েছে। আমরা তাদের আধিপত্য আর মানতে রাজি নই।
চীনের সঙ্গে আমরা ভারসাম্যপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই—স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে।
এই বিপ্লব কারও দয়া বা বিদেশি হস্তক্ষেপে আসেনি—এটি এসেছে আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগে। তাই আমাদের কারো কাছে ঋণ নেই, আমরা স্বাধীনভাবে কূটনীতি চালিয়ে যাব—যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত—সবার সঙ্গে সমানভাবে।
ইয়েনি সাফাক: আপনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? তরুণদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী? আর আপনি নিজে কী করবেন?
সাদিম কায়েম: আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার ও স্বপ্ন রক্ষিত হবে—জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, কিংবা মতাদর্শ নির্বিশেষে।
যেখানে সরকার হবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, থাকবে মতপ্রকাশ ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, এবং আইনের শাসন—যেখানে আইন হবে সকলের জন্য সমান।
আমরা চাই এমন অর্থনীতি, যেখানে ধনিক শ্রেণির একচেটিয়া ক্ষমতা নয়—গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, নারী ও যুবকের জন্য হবে স্বনির্ভরতা ও সম্ভাবনার পথ।
আমরা চাই এমন শিক্ষা, যা কেবল পরীক্ষায় পাস করানো নয়—চিন্তা, মানবিকতা ও নৈতিকতাকে উৎসাহিত করবে।
তরুণদের বলব—এই বিপ্লব প্রমাণ করেছে, তরুণরাই জাতির চালিকাশক্তি। তোমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, পোস্ট, প্রতিবাদ—সবই ইতিহাস গড়েছে। কখনও নিজের কণ্ঠকে তুচ্ছ ভেবো না।
আমি নেতৃত্বকে দেখি দায়িত্ব হিসেবে, ক্ষমতা নয়। আমি এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর যে ভালোবাসা ও আস্থা পেয়েছি—তা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
তবে আমি রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখি না। আমি চাই নেতৃত্ব গড়ে উঠুক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক হয়ে—ব্যক্তিনির্ভর নয়।
আমি নিজেকে দেখতে চাই এক সংগঠক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে—যিনি তরুণ নেতৃত্বের বিকাশে সহায়তা করবেন।
নতুন বাংলাদেশ শুধু সম্ভাবনা নয়—এটি সময়ের দাবি। হয় আমরা এগিয়ে যাব, নয়তো আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যাব। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এবার আমরা এগিয়ে যাব—কারণ তরুণরা জেগে উঠেছে, জনগণ আর পেছনে ফিরবে না।