
জুলাই অভ্যুত্থানের পর তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং জামায়াতে ইসলামী মাঠের আন্দোলন কিংবা দাবি-দাওয়া আদায়ের আলোচনায় দৃশ্যত হাঁটছিল একই পথে। নির্বাচন ও সংস্কার ইস্যুতে দল দুটির মধ্যে এক ধরনের ঐকমত্য দেখা গিয়েছিল। রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক ক্ষেত্রেই জামায়াত এবং এনসিপি সহাবস্থান নিচ্ছিল বলে মনে করছিলেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রেখে চলা দল দুটির চলার পথের সহাবস্থানে হঠাৎই ছন্দপতন হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির টানাপোড়েন দৃশ্যমান হয়। মূলত জুলাই সনদ ইস্যুতে তৈরি হওয়া মতভিন্নতায় সর্বশেষ গত রোববার যেন ‘আগুনে ঘি’ ঢেলে দেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি জামায়াতের ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) আন্দোলন’কে ‘পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ আখ্যা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন, যা দুপক্ষের মধ্যকার বিভেদকে আরও প্রকাশ্যে আনে। অনেকেই এ ঘটনাকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরূকরণের আভাস হিসেবে দেখছেন।
তাদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে নানা ইস্যুতে ঐকমত্য দেখা গেলেও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার জেরে জামায়াত-এনসিপি সম্পর্কের দূরত্ব এখন স্পষ্ট, যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এনসিপি হয়তো নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধতে পারে—এমন অবস্থান থেকে নতুনভাবে আলোচনায় আসতে চাইছে। তবে বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার এ প্রক্রিয়ায় এনসিপিতে থাকা বাম ঘরানার নেতারা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন বলে সূত্রের দাবি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন ও সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একসময় কাছাকাছি অবস্থানে থাকা জামায়াত-এনসিপির মধ্যকার সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বিশেষত ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর এবং পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দাবিতে জামায়াতের ডাকা আন্দোলনে এনসিপির যোগ না দেওয়াকে কেন্দ্র করে। নানা কারণে আলোচিত এ দুটি দলের মধ্যে টানাপোড়েন রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ কৌতূহল ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জামায়াতের পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবিতে আন্দোলনকে ‘পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা’ বলে মন্তব্য করেন। তার এ বিস্ফোরক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী অসন্তোষ প্রকাশ করে শিষ্টাচার বজায় রাখার এবং দোষারোপের রাজনীতি পরিহারের আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে এ-ও বলে যে, কোনো দল বা ব্যক্তি রাজনৈতিক অবস্থান হারালে এমন মন্তব্য করতে পারে। অবশ্য পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই টানাপোড়েন উভয় দলের ভিন্ন রাজনৈতিক কৌশল এবং স্বার্থের সংঘাতের ফল। জামায়াত যখন যুগপৎ আন্দোলনে অন্যান্য দলকে পাশে চাইছে, ঠিক তখন এনসিপি নিজস্ব পথে চলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ দূরত্ব ভবিষ্যতে দুটি দলের রাজনৈতিক সমীকরণে কী ধরনের পরিবর্তন আনে, সেদিকেই এখন নজর সবার।
গত বছর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির উল্লেখযোগ্য মতের মিল দেখা যায়। আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জোট হিসেবেও ভাবা হচ্ছিল এই দুই দলকে; দল দুটির অভ্যন্তরেও চলছিল সে আলোচনা। তবে হঠাৎ করেই সে সম্পর্কের মধ্যে তৈরি হয়েছে টানাপোড়েন। বিশেষ করে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা না করা নিয়েই দুই দলের দূরত্ব প্রকাশ্যে আসে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা না পেলে জামায়াতে ইসলামী জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেবে না—এমনটাই ধরে নিয়েছিল এনসিপি। তাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্যেও সেই ইঙ্গিত ছিল। এনসিপিও আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থান নেয়। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার অনুরোধ এলেও তারা অবস্থান পরিবর্তন করেনি। দলটির ধারণা ছিল, জামায়াতসহ আরও কয়েকটি দলও আইনি ভিত্তি ছাড়া অনুষ্ঠানে যাবে না। তবে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয় এবং সনদে স্বাক্ষর করে। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি এনসিপির নেতাকর্মীরা; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জামায়াতের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনাও করেন তারা।
গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপি, জামায়াতসহ ২৪টি দল-জোটের প্রতিনিধিরা জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরাও তাতে সই করেন। জামায়াত ও এনসিপির একাধিক সূত্র জানায়, সনদ স্বাক্ষর নিয়ে দুই দলের মধ্যে পূর্বে যোগাযোগ ছিল এবং উভয় দলই শুরুতে আইনি ভিত্তি ছাড়া সনদে স্বাক্ষর না করার পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে সরকারের বারবার অনুরোধ এবং রাজনৈতিক কৌশল বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত জামায়াত অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এনসিপিকেও সে বিষয়ে জানায়। এমনকি সনদ স্বাক্ষরের দিন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে ফোন করে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অনুরোধ করেন; কিন্তু নাহিদ তাতে সম্মত হননি। তার আগে জামায়াতকে স্বাক্ষর না করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এনসিপির নেতারা।
এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা কালবেলাকে বলেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে এনসিপির যে সম্ভাব্য জোট সে আলোচনাতেও ভালোভাবে ছিল জামায়াতে ইসলামী। এ বিষয়ে দলের নির্বাহী সভায়ও অনেকে ইতিবাচক ছিলেন। তবে এনসিপি আগেই জানিয়েছিল, জুলাই সনদে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। কেননা এই জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন ও সামগ্রিক রাজনীতি পরিচালিত হবে। জামায়াতও এ বিষয়ে অনড় ও এনসিপির সঙ্গেই থাকবে বলেই আমাদের ধারণা ছিল। বলা যায়, অনেকটা বিশ্বাসভঙ্গ হয়েছে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত জামায়াত সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা তাদের (জামায়াত) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তবে তারা আগেই বলেছিলেন, বাস্তবায়ন পদ্ধতির নিশ্চয়তা ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করবেন না। তারা এ-ও বলেছেন, বাস্তবায়ন না হলে স্বাক্ষর উঠিয়ে নেবেন। স্বাক্ষর করার পর কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় উঠিয়ে নেওয়া হবে, তা পরিষ্কার নয়। এদিক থেকে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান বেশ এলোমেলো মনে হচ্ছে। এনসিপি তার অনড় অবস্থানেই আছে। আমরা জুলাই সনদ নিয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করব না।’
জুলাই সনদ ইস্যুতে তৈরি হওয়া দূরত্বে সর্বশেষ ‘আগুনে ঘি’ ঢেলে দেয় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্ট। গত রোববার বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘পিআর আন্দোলন’ একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিতে জামায়াত যে আন্দোলন চালাচ্ছে, সেটিকে তিনি ‘কথিত আন্দোলন’ বলেও অভিহিত করেন। নাহিদের এ মন্তব্যে জামায়াত-এনসিপির দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়। দুই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যেও দেখা যায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় বিতর্ক ও তর্কাতর্কি। পরবর্তী সময়ে নাহিদের মন্তব্যের জবাবে জামায়াতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দেওয়া হয়।
জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে নাহিদ লিখেছেন, ‘আমরা মৌলিক সংস্কার এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম; কিন্তু জামায়াত ও তার সহযোগীরা এটা ছিনতাই করেছে। তারা একে একটি কাঠামোগত পিআর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং এটাকে তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দরকষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।’
নাহিদের এ বক্তব্যের বিষয়ে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘এনসিপির আহ্বায়ক জামায়াত সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার বাস্তবতা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি তাদের এজেন্ডা সংস্কারপন্থি নয়। মৌলিক সংস্কারের পক্ষে তারা সেভাবে অংশ নেয়নি। উচ্চকক্ষে পিআরের বিষয়ে যেখানে প্রায় সবাই একমত, সেখানে জামায়াতসহ কয়েকটি দল কৌশলগতভাবে তা নিম্নকক্ষে পিআরের আলোচনায় নিয়ে যায়। যার কারণে উচ্চকক্ষে পিআরসহ অনেক মৌলিক সংস্কারের আলোচনা হারিয়ে যায়। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, কারও বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কিংবা খুশি করার জন্য এনসিপি রাজনীতি করবে না।’
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘যে কোনো দলের ব্যাপারে অন্য দলের শিষ্টাচার বজায় রেখে মন্তব্য করা ভালো। দোষারোপের রাজনীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, পুরোনো রাজনৈতিক ধারা এটাই ছিল। রাজনীতির সেই পুরোনো ধারা থেকে বের হয়ে আমরা চেয়েছিলাম ব্লেম-গেমের রাজনীতিকে বিদায় করতে। আমরা চাই ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারা তৈরি করতে। সেটাই প্রত্যাশা ছিল আমাদের।’
তিনি মনে করেন, কোনো দল বা ব্যক্তি যখন সামঞ্জস্য কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান হারিয়ে ফেলে যে কোনো কিছুই বলতে পারে। সেটা যে কোনো দলের কৌশল কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান। এনসিপি প্রসঙ্গে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, যারা নিজেরা জাতিকে স্বপ্ন দেখানোর কথা বলে, যারা জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করেন এবং আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে, সে জায়গা থেকে তাদের সবাইকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই কাজ করা উচিত। তিনি মনে করেন, এ ধরনের বক্তব্য ছিল পুরোনো রাজনৈতিক ধারা। যে কারণে এনসিপিরও উচিত ছিল দায়িত্বশীলতা ও সৌজন্যতাবোধ বজায় রেখে মন্তব্য করা।
নাহিদ ইসলামের ফেসবুক পোস্টের বক্তব্য অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর দাবি করে প্রতিবাদ জানায় জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জুবায়ের রোববার রাতেই এক প্রতিবাদ বিবৃতিতে বলেন, ‘ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম দাবি পিআর পদ্ধতির সমালোচনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। জামায়াতে ইসলামীর পিআর দাবির আন্দোলনকে প্রতারণামূলক ও রাজনৈতিক কৌশল বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা ও দুঃখজনক। তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে কী বোঝাতে চাচ্ছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তার কাছে এ ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবিতে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এবং রাজপথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার দৃঢ় অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। কাজেই নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই। নাহিদ ইসলামকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াত নেতা এহসানুল মাহবুব।’
সূত্র: কালবেলা