
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনে প্রার্থীরা নিজেদের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছে। প্রতিদিনেই সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এ আসনে বিএনপিতে প্রার্থিতার লড়াই থাকলেও জামায়াতের রয়েছে একক প্রার্থী।
বিএনপিতে প্রার্থিতার লড়াই তুঙ্গে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা কখনো রাজধানী, কখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটছেন। হাইকমান্ডের নজরে আসতে চলছে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। নেতাকর্মীদের মন জয়েও চলছে নানা প্রতিশ্রুতি আর ব্যক্তিগত যোগাযোগ বৃদ্ধির নানা আনুষ্ঠানিকতা। তবে চায়ের চুমুকে গরম সংলাপ এখন ‘কে হচ্ছেন ধানের শীষের প্রার্থী। সাধারণ মানুষের নিকট যোগ্যতা, দক্ষতা আর গ্রহণ যোগ্যতার চলছে ব্যারোমিটার।
এ আসনে ধানের শীষের প্রার্থিতার লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বিগত তিনবার দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার এম ইকবাল হোসাইন, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরন, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাফেজ মো. আজিজুল হক, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হক, ড্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি ডা. আব্দুস সেলিম, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা মহিলা দলের সভাপতি তানজিন চৌধুরী লিলি, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা যুবদলের সভাপতি শামছুল হক (ভিপি শামছু) ও জাসাস কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি কবি সেলিম বালা।
আর একক প্রার্থী হিসাবে প্রচার চালাচ্ছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গৌরীপুর শাখার আমির মাওলানা মো. বদরুজ্জামান। দলীয় একক প্রার্থী ঘোষণা করায় তিনি নির্বাচনি মাঠের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের ছুটছেন। চলছে নিয়মিত সভা-সমাবেশও।
জাকের পার্টির প্রার্থী হিসাবে মো. নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসাবে সিপিবির উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন আল বারী নাম শোনা যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা সিপিবির সভাপতি মজিবুর রহমান ফকির বলেন, তিনি এর আগেও একাধিকবার প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় পর্যায়ে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়নি। দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মানুষের জনবান্ধব কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি।
এছাড়াও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস গৌরীপুর উপজেলা শাখার সহ সভাপতি মো. ফজলুর রহমান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ গৌরীপুর উপজেলা শাখার সভাপতি মুফতি নাজিম উদ্দিন এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ গৌরীপুর উপজেলার মনোনীত প্রার্থী মো. আইয়ুব আলী নূরানীও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জানা যায়, উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নির্বাচনি আসন ১৪৭, ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর)।
উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. ফাওজুল কবীর খান জানান, এ আসনে এবার মোট ভোটার ২ লাখ ৯৪ হাজার ৬০৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬৯ জন। নারী ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৪৬ হাজার ১৩৯ জন। এ আসনটিতে ১৯৭৯ ও ১৯৯৬ সালে জয়ী হয় বিএনপি, ১৯৮৬ ও ৮৮ সালে জাতীয় পার্টি, ১৯৯১, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ দ্বাদশ নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
২০০৮ সালে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির এক লাখ ৭৭ হাজার ২৮০ পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার এম ইকবাল হোসাইন। তিনি পেয়েছিলেন ৭৬ হাজার ৫১৭ ভোট। এ নির্বাচনে জাকের পার্টির প্রার্থী গোলাম মোহাম্মদ ৩ হাজার ১৬৭ ভোট, ন্যাপের প্রার্থী মো. আবদুর মতিন ৩ হাজার ১৬৭ ভোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী মো. মতিউর রহমান ৪৭৭ ভোট ও গণফোরামের প্রার্থী মো. রজব আলী ২৫৫ ভোট পান। এ নির্বাচনে ২ লাখ ৬০ হাজার ৮৮৮ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। যা মোট ভোটের ৮৪.৫ শতাংশ।
তবে বিএনপির ভোট বর্জনের ঘোষণায় ব্যতিক্রম ঘটে ২০২৪ সনের অনুষ্ঠিত দ্বাদশ নির্বাচনে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট নিলুফার আনজুম পপি পান ৫৪ হাজার ৪৯১ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী সোমনাথ সাহা পান ৫২ হাজার ৫৬৬ ভোট। এ নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৬ জন। ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ১ লাখ ৭ হাজার ৫৭ জন। যা মোট ভোটারের ৩৮.৮৮ শতাংশ।
আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের নির্যাতন-নিপীড়ন ও দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা দায়ের করা হয়। দলীয় কর্মসূচি পালন করতে এসে হামলারও শিকার হন একাধিক সময়ে। তবে হামলা-মামলা প্রতিরোধের জন্য সরকারবিরোধী আন্দোলনে একাট্টা হতে ব্যর্থ হয় উপজেলা, পৌর বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ভাষা দিবসে শহীদ মিনারে ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি’র স্লোগানও হয়েছে পৃথক ৬ গ্রুপে। নেতাদের দীর্ঘদিনের বিরোধের ঢেউ লেগেছে তৃণমূল কর্মীদের মাঝেও, সেখানে সৃষ্টি করেছে বিভাজন।
মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব-অপছন্দ থাকলেও ১০টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার কর্মীদের দাবি ধানের শীষের প্রশ্নে তারা এক ও অভিন্ন, তাদের কথা ‘যিনি পাবেন ধান, তিনি হবেন প্রাণ।’
৩৬ জুলাই অভ্যুত্থানের পরে নেতাকর্মী বেড়েছে, বেড়েছে সভা-সমাবেশ। সেসব সভা-সমাবেশ করে কর্মীরাও নেতাদের মন জয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন। ফ্যাসিস্টের দীর্ঘদিনের ভোটবিহীন নির্বাচনের কারণে ভোটারদের মাঝেও ভোট দেওয়ার সেই সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এম ইকবাল হোসাইন বিগত সরকারের আমলে নানা হামলা ও মামলার শিকার হন। দেশজুড়ে আলোচিত আন্তঃনগর হাওড় এক্সপ্রেসে নাশকতার অভিযোগের মামলাতেও আসামি ছিলেন তিনি। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের তোপের মুখেও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে তার গ্রুপের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিলেন।
৫ আগস্টের পর নিজ এলাকায় গাড়িবহরে হামলার শিকার হলে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্দেশে দলীয়ভাবে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্লিন ইমেজের মানুষ হিসাবেই পরিচিত ইঞ্জিনিয়ার এম ইকবাল হোসাইন। তিনি জানান, হাইকমান্ড বলেছে কাজ করতে আমি কাজ করছি, ধানের শীষের জন্য কাজ করছি। মনোনয়নের ক্ষেত্রেও শতভাগ আমি আশাবাদী।
অন্যদিকে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ। তিনি উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিগত সময়ে বিপুল ভোটে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দলীয় কর্মসূচী পালনে তিনি সর্বদা সক্রিয় ছিলেন। জেল-জুলুম-হুলিয়া ছিল হিরণের নিত্যসঙ্গী। শত মামলা নিয়েও নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন।
আহাম্মদ তায়েবুর রহমান হিরণ বলেন, দলীয়ভাবে যে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সব কয়টি ক্রাইটেরিয়ায় আমি উত্তীর্ণ। এছাড়া সাংগঠনিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়কে প্রাধান্য দিলে অবশ্যই আমি মনোনয়ন পাব। আল্লাহর রহমতে শতভাগ নিশ্চিত।
উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব হাফেজ আজিজুল হক সংগঠনের কর্মসূচি পালনে ফ্যাসিস্টদের হামলার শিকার হন তিনি। ছিলেন ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। নবকমিটিতে তিনি উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব নির্বাচিত হয়েছেন।
হাফেজ আজিজুল হক বলেন, দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান কথা হয়েছে। আমি ক্লিন ইমেজের মানুষ। চাঁদাবাজি, ধান্ধাবাজি করি না। দলের দুঃসময়ে নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি। মনোনয়নের পাব ইনশাল্লাহ। তবে ধানের শীষ যিনিই পাবেন, তাকেই বিজয়ী করতে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল হক ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন অ্যাডভোকেট নুরুল হক। তিনি ময়মনসিংহ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেন। ময়মনসিংহ জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতিও ছিলেন।
অ্যাডভোকেট নুরুল হক যুগান্তরকে বলেন, দলের দু:সময়ে প্রত্যেকটি কর্মসূচি সফল করেছি। হামলা-হামলায় আহত নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছি। মামলার শিকার নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি। ধানের শীষের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি। ইনশাল্লাহ মনোনয়ন পাব।
সূত্র : যুগান্তর










































