
চলন্ত ট্রেনের ভেতর থেকে কেউ তার হাত ধরে রেখেছেন আর দরজার বাইরে ঝুলছেন এক ব্যক্তি। একপর্যায়ে ভেতর থেকে হাত ছেড়ে দিলে লোকটিকে ট্রেনের নিচে পড়ে যেতে দেখা যায়। এ ঘটনার ৩৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভিডিওটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাটি রবিবার (১৮ মে) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নসরতপুর রেলস্টেশন এলাকায় ঘটেছে।
ট্রেন থেকে নিচে পড়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম মতিউর রহমান। তার বাড়ি নওগাঁর রানীনগর উপজেলার পারইল গ্রামে। ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে মতিউরকে চোর এবং ছিনতাইকারী বলে দাবি করা হয়।
ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, মতিউর পেশায় একজন অটোরিকশাচালক ছিলেন। দুই বছর ধরে দূতাবাস এবং এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কাজ করছেন তিনি। ১৫ দিন আগে বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার তালশান গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের ছেলে সজীব হোসেনকে সাড়ে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠান তিনি। সৌদিতে যাওয়ার পর বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় সজীবের পরিবারের সদস্যরা সপ্তাহখানেক আগে মতিউরের বাড়ি যান এবং কাগজপত্রের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তারই জের ধরে বগুড়া থেকে বাড়ি ফেরার পথে মতিউরকে একা পেয়ে সজীবের ছোট ভাই রাকিব এবং সজীবের শ্যালকরা মোবাইল ফোন চোর এবং ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে ট্রেন থেকে তাকে ফেলে দেন এবং নগদ ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন বলে অভিযোগ মতিউরের পরিবারের।
এ বিষয়ে মতিউর রহমানের ছেলে আহসান হাবিব বলেন, ‘‘আমার বাবা অটোরিকশাচালক ছিলেন। গত দেড় বছর ধরে সৌদি আরবের লোক পাঠানোর কাজ করছেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৩-৪ জনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন, তারা সেদেশে ভালোই আছে। ১৫ দিন আগে আমার বাবা বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার তালশন গ্রামের মোহাম্মদ হেলালের ছেলে সজীব হোসেনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হওয়ায় সজীব তার বাবাকে আমাদের বাড়িতে পাঠান। তার বাবা বাড়িতে এসে আমাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে যান। আর বগুড়া থেকে ট্রেনে বাড়িতে ফেরার পথে সজীবের ছোট ভাই রাকিব এবং তার শ্যালকরা আমার বাবাকে মোবাইল চোর বলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং প্রায় ৪-৫ মিনিট ট্রেনে ঝুলিয়ে রাখেন। একপর্যায়ে ট্রেনটি আদমদিঘী উপজেলার নশরতপুর স্টেশনে পৌঁছালে সেখানকার প্লাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আমার বাবা ট্রেনের নিচে পড়ে যান। ট্রেনের নিচে পড়লেও বাবা কোনোরকম প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু সেখানকার উৎসুক জনতা আমার বাবাকে মোবাইল চোর এবং ছিনতাইকারী ভেবে বেধড়ক মারধর করতে থাকেন।’’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভুক্তভোগীর ছেলে আরও বলেন, ‘‘পরে বাবাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আদমদিঘী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আদমদীঘি থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে তারা আমার অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। আদমদিঘী থানার ওসি আমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেন। তিনি আমাকে বলেন, ‘এটি রেলওয়ের বিষয়, এই অভিযোগ সান্তাহার রেলওয়ে থানায় গিয়ে করুন।’ পরে আদমদিঘী থানা পুলিশের কথা শুনে সান্তাহার রেলওয়ে থানায় অভিযোগ জানাতে যাই। তবে সান্তাহার রেলওয়ে পুলিশ জানায়, আপনার বাবা জীবিত। মারা গেলে মামলা নেওয়া যেত। আমরা এখন কোথায় অভিযোগ করব? আমার বাবা তো ছিনতাইকারী বা চোর নন। তিনি বৈধ পথে ব্যবসা করছেন। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।’’
বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার সান্তাহারের বাসিন্দা নেহাল আহমেদ বলেন, ‘‘মতিউরকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি। তার মাধ্যমে আমার দুই আত্মীয়কে বিদেশে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। মতিউরের সঙ্গে লেনদেন নিয়ে কখন কারও ঝামেলা হতে দেখিনি।’’
অভিযোগের বিষয়ে সজীবের বাবা মোহাম্মদ হেলাল বলেন, ‘‘প্রায় দেড় মাস আগে সজীবকে মতিউরের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমার ছেলে কাজের সুযোগ পায়নি। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি। কিন্তু সে আমার সঙ্গে দেখা না করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন। সাত থেকে আট দিন আগে তার বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম ছেলের বিষয়ে জানতে, তবে সেখানে কোনো ঝামেলা হয়নি।”
ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে ছেলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘বগুড়া থেকে আসার সময় সজীবের শ্যালকরা ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে মতিউরকে ফেলে দেয়। তবে রাকিব সেখানে কিছুই করেনি। ট্রেনে কি হয়েছে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’’
অভিযোগ প্রসঙ্গে বগুড়া আদমদিঘী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এটি রেলওয়ে পুলিশের বিষয়। তাই আমরা কোনো অভিযোগ নেয়নি।’’
এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সান্তাহার রেলওয়ে থানা পুলিশের পরিদর্শক (ওসি জিআরপি) মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘তারা প্রথমে আদমদিঘী থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদেরকে জিআরপিতে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। তখন তারা আমার থানায় এসেছিলেন। আসার পরে তাদেরকে নাকি আবার আদমদীঘি থানা থেকে মোবাইল ফোন করা হয়। তখন তারা আবারও আদমদিঘী থানায় অভিযোগ জানাতে চলে যান। পরবর্তীতে তারা আর আমার থানায় আসেননি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা সবসময় অভিযোগ এবং তদন্ত সাপেক্ষে মামলা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন